উত্তর আমেরিকার সর্ব দক্ষিণের শহর ভ্রমণ!
Tweet
আফসিয়া আলম আনিকাঃ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থিত শহরটির নাম- কি ওয়েস্ট! যেই শহরটি থেকে কিউবার হাভানা শহর খুব বেশি দূরে নয়। মায়ামী থেকে কি ওয়েস্টের দূরত্ব কি ওয়েস্ট থেকে হাভানার দূরত্বের প্রায় দিগুণ। আমেরিকার সর্ব দক্ষিণের শহরের আবার সবচেয়ে দক্ষিণে একটি পয়েন্ট চিহ্নিত আছে “সাউদার্নমোস্ট পয়েন্ট” হিসেবে। এই দ্বীপে যারা বেড়াতে আসেন, তাদের ওই পয়েন্টে ছবি তোলা চাই-ই চাই। কারণ এই পয়েন্টকে আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের শেষপ্রান্ত হিসেবেও ধরা হয়। ভরা মৌসুমে এখানে এতটাই ভীড় থাকে যে ছবি তোলার জন্য রীতিমতো লম্বা লাইন পড়ে যায়।
এই দ্বীপের আসল সৌন্দর্য ঐতিহ্যবাহী বাড়িঘর এবং রাস্তাঘাট। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটকের আগমন ঘটে এই দ্বীপে তবুও শহরটির ঘর-বাড়ী, রাস্তা-ঘাট, এমনকি হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতেও শত বছরের পুরনো ধাঁচ বজায় রাখা হয়েছে। শত বছরের পুরনো নকশা কিন্তু আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত রেস্তোরাঁ ও আবাসন ব্যবস্থা।
প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের চারিদিকেই ঘিরে আছে সমুদ্র। শুধুমাত্র একটি ব্রিজ দিয়ে সংযোগ রক্ষা করা হয়েছে মূল সড়কের সাথে। আয়তনে খুব বড় না হলেও দ্বীপটিতে রয়েছে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান। পর্যটন আকর্ষণের জন্য রয়েছে প্যারাসেলিং, কায়াকিং, স্নোরকেলিং, স্কুবা ডাইভিং সহ আরো অনেক কর্মকাণ্ড। আরও আছে সমুদ্র ভ্রমণের জন্য ছোট-বড় বোট যেগুলো পর্যটকদেরকে নিয়ে যায় সমুদ্রের মাঝখানে ডলফিল বা সূর্যাস্ত দেখতে। রয়েছে বেশ কয়েকটি জাদুঘর যেগুলোতে প্রদর্শিত হচ্ছে দ্বীপটির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, পুরো শহরজুড়েই আপনি দেখতে পাবেন কিছু হাঁসমুরগি নিজের মতো করে ছানাগুলোকে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে এই দৃশ্য দেখা যায়। বাংলাদেশ থেকে সাতসমুদ্র তের নদীর ওপারের কোন শহরে এই দৃশ্য নিশ্চয়ই আপনাকে মুগ্ধ করবে!
আমেরিকার সবচেয়ে দক্ষিণের শহর কি ওয়েস্ট দ্বীপের কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয় “ম্যালোরি স্কোয়ার”কে। এই স্কোয়ারের পাশ ঘেঁষেই রয়েছে বড় বড় জাহাজ নোঙ্গর করার বন্দর। দ্বীপের প্রধান প্রধান পর্যটন আকর্ষণসমূহ এই বন্দরের আশেপাশেই। দ্বীপটির প্রধান সড়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয় “ড্যুভেল স্ট্রিট”কে। এই সড়কের পাশে রয়েছে এশিয়া, ইউরোপ তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশীয় খাবারের রেস্তোরাঁ। তবে ক্যারিবিয়ান (প্রধানত কিউবান) বা মেক্সিকান রেস্তোরাঁই চোখে পরবে বেশি। এই দ্বীপে অন্যতম আকর্ষণ হয়ে রয়েছে বেশকিছু পার্ক।
ভরা মৌসুমে প্রধান সড়ক এবং দর্শনীয় স্থানগুলোতে প্রচুর ভীড় থাকে। ফলে যারা ভীড় এড়িয়ে একটু নিরিবিলি সময় কাটাতে পছন্দ করেন তাদের জন্য এই পার্কগুলো বেশ উপযুক্ত জায়গা। আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল “ফোর্ট জ্যাছারি টেইলর হিস্টোরিক স্টেট পার্ক”। এই পার্কের ভেতরে রয়েছে সাজানো গোছানো জাদুঘর, সি-বিচ, পিকনিক স্পট এবং সানসেট পয়েন্ট।
কি ওয়েস্টের অদূরে সমুদ্রের ভেতরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি “ন্যাশনাল পার্ক”। এটিও একটি ছোটখাট দ্বীপ। নাম ড্রাই টরটুগ্যাচ। মজার ব্যাপার হল পুরো দ্বীপটি জুরেই আছে মাত্র একটি স্থাপনা- ১০০ বছর পুরোন একটি দূর্গ। স্থাপত্যশৈলী এবং জীব বৈচিত্র্যর বিচারে এই দ্বীপকে ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায় কি ওয়েস্ট দ্বীপ ভ্রমনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং উপভোগ্য দিকটি হলো “ড্রাইভিং”। ফ্লোরিডার মায়ামি শহর থেকে প্রায় ২৬০ কিলোমিটার দূরের এই দ্বীপে পৌঁছতে পারি দিতে হয় আরো অনেকগুলো দ্বীপ। এই দ্বীপগুলোকেই ওরা নাম দিয়েছে “কি”- বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় চাবি। কিন্তু এখানে “কি” বলতে বুঝানো হয়েছে দ্বীপপুঞ্জের এক একটি দ্বীপকে। অনেকটা কম্পিউটারের কি-বোর্ডের “কি” এর মতন। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে একটার সাথে আরেকটা সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে অগভীর সমুদ্র ভরাট করে রাস্তা বানিয়ে। তবে কোথাও কোথাও বিশাল সেতু তৈরি করে। সবচেয়ে বড় সেতুটি ৭ মাইল দীর্ঘ (প্রায় ১১ কিলোমিটার), তাই এর নাম “সেভেন মাইল ব্রিজ”।
এই রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে যেতে এমন অনেকগুলো জায়গা পাওয়া যাবে যেন মনে হবে গাড়ি চালিয়ে সমুদ্রের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি! আর পুরো পথের অনেক জায়গাজুড়ে দু’পাশে শুধুই সমুদ্র। একদিকে আটলান্টিক, অন্যদিকে গালফ অব মেক্সিকো। গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে আপনি চাইলে কিছুক্ষণের জন্য থামতেও পারবেন। থামার জন্য পার্কিং এর জায়গা করে দেয়া আছে। কিছু জায়গায় আবার মাছ ধরা এবং হেঁটে বেড়ানোর জন্যে সমুদ্রের ভেতর পর্যন্ত তৈরি করা আছে সরু ব্রিজ বা পিয়ার।
এই দ্বীপে যাবার পথে অন্যান্য দ্বীপগুলোতে চোখে পড়বে বিভিন্ন ধরনের এমিউজমেন্ট পার্ক। কোনটায় টিকেট কেটে আপনি ডলফিল শো দেখতে পাবেন, আবার কোনটাতে হরিণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এসব পার্কের যেকোনটিতে চাইলে ঘুরেও আসতে পারেন কি ওয়েস্ট যাওয়ার পথে। প্রত্যেকটা দ্বীপেই রয়েছে সমুদ্র লাগোয়া বিভিন্ন ধরণের হোটেল। এগুলোকে অবশ্য হোটেল না বলে, বাড়িও বলা যায়। কারণ অনেকেই বছরের কিছু সময় অবকাশ যাপনের জন্য এখানে বাড়ি কিনে রাখেন। বছরের বাকি সময়টাতে পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেন। সমুদ্রের খুব কাছাকাছি হওয়ায় প্রতিটি হোটেলেই রয়েছে হরেক রকমের ওয়াটার এক্টিভিটিজ।
মায়ামি থেকে দিনে গিয়ে দিনেই কি ওয়েস্ট ঘুরে ফেরত আসতে চাইলে বের হতে হবে খুব ভোরে। যেন প্রথম কি “কি লারগো”তে গিয়ে সূর্যোদয় দেখা যায়। এরপর সেখান থেকে নাশতা সেরে যাত্রা করে অন্যান্য কি গুলোতে কিছুটা থেমে থেমে দুপুর নাগাদ কি ওয়েস্টে পৌঁছতে পারলেও বেশ খানিকটা সময় পাওয়া যাবে। এরপর দিনের বাকিটা সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গা ঘুরে সূর্যাস্ত দেখে ফেরার পথ ধরতে হবে। মায়ামি থেকে কি ওয়েস্ট ভ্রমনে যাওয়া আসা মিলে ৭ থেকে ৯ ঘন্টার ড্রাইভ।
তবে “কি ওয়েস্ট দ্বীপ” ভ্রমণে সেখানে অন্তত এক/দুই রাত থাকার পরিকল্পনা করা ভালো। সেক্ষেত্রে অন্যান্য দ্বীপগুলোতেও ভালো করে ঘোরার সুযোগ পাওয়া যাবে। অন্যান্য কি গুলো কিছুটা কম জনপ্রিয় হওয়ায় ভীড়ও কম, তাই একটু বেশি ওয়াইল্ড। সেখানে বিভিন্ন প্রকারের সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন পশু পাখির সমাহার। এমনকি রয়েছে প্রাণী সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র, জাদুঘর ইত্যাদি। এসব কারণে অনেকেই ওসব কি গুলোতেও ভ্রমণে যেতে পছন্দ করেন ফলে রাত্রিযাপন অনিবার্য হয়ে যায়। বিশেষ করে বিনোদনপ্রিয় ও ভাববিলাসী পর্যটকগণতো একরাত হলেও সমুদ্রের কোলঘেঁষে কাটাতে পছন্দ করেন। এখানে বলে রাখা ভালো কি গুলোতে থাকার হোটেল খরচ মূল ভূখণ্ডের হোটেল খরচ থেকে অনেক বেশি। তাই অনেকেই মায়ামি কিংবা এর আশেপাশের শহরে থেকে ভ্রমন পরিকল্পনা করেন।
এবার আসি কি ওয়েস্টে ভ্রমণে যাবেন কিভাবে সেই প্রসঙ্গে। পৃথিবীর যেকোন শহর বা দেশ থেকে ফ্লোরিডার মায়ামি বা এর আশেপাশের যেকোন শহরে আসতে হবে প্রথম। তারপর সেখান থেকে একদিন অথবা দুই/তিন দিনের ভ্রমন পরিকল্পনা করে গাড়ি নিয়ে যেতে হবে আমেরিকার সবচেয়ে দক্ষিণের শহর কি ওয়েস্ট।
লেখকঃ
ড. খাইরুল আলম সিদ্দিকী (অহন)
এসিস্ট্যান্ট রিসার্চ সাইন্টিস্ট
ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ আউটকামস এন্ড বায়োমেডিক্যাল ইনফরমেটিক্স
ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা | কলেজ অব মেডিসিন।