আলোকিত রন্ধনশিল্পী রাবেয়া
Tweet
রাবেয়া সুলতানা আঁখি
বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি পল্লী ময়ের কোল,
ঝাউশাখে যেথা বনলতা বাঁধি হরষে খেয়েছি দোল
কুলের কাটার আঘাত সহিয়া কাঁচা পাকা কুল খেয়ে,
অমৃতের স্বাদ যেন লভিয়াছি গাঁয়ের দুলালী মেয়ে
পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশীতে বিষম খেয়ে,
আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।
মায়ের বকুনি পেয়েও যে উল্লাস বাড়ে তা আদি, অকৃত্রিম ও প্রানবন্ত। প্রথিতযশা কবি সুফিয়া কামালের পল্লী স্মৃতি নামক কবিতাটি থেকে উপরের কয়েকটি লাইন আশ্রয় করে আমরা বলতে চাচ্ছি আধুনিক ও নিজগুণে গুণান্বিত রন্ধনশিল্পী রাবেয়া সুলতানা আঁখি সমন্ধে কিছু কথা। বিগত শতাব্দীর সত্তর থেকে নব্বই দশকে যাদের জন্ম তাদের কাছে এই কবিতাটির গুরুত্ব সবসময়ই আলাদা। কবিতায় পল্লী সমাজে বেড়ে ওঠাদের শৈশবকালের যে বর্ণনা দেওয়া আছে তা সেই সময় বা তারও আগে জন্মগ্রহণকারীদের প্রায় সকলের জীবনের সাথেই মিলে যায়। ফলে কবিতাটিকে তাদের একান্ত আপন মনে হয়। মনে হয় এ যেনো কাগজ-কলমে তাদেরই জীবন চিত্রিত করা আছে ছন্দে ছন্দে;অক্ষরে অক্ষরে। কবিতার কথাগুলো সবার জীবনের গল্পের সাথে অনেকাংশে মিলে গেলেও কারও কারও জীবনের সাথে মিলে যায় হুবহু। আমাদের রাবেয়া সুলতানা আঁখি তেমনই একজন।
রাবেয়া ১৯৭৮ সালে পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া থানাধীন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাটিভাঙ্গা গ্রামে নিজ বাড়িতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। শৈশবের সোনালী দিনগুলি কেটেছে বউপুতুল আর চড়ুইভাতি খেলে। মাঠে-ঘাটে, জলে-জঙ্গলে দুরন্তপনা করা, ছিপ দিয়ে মাছ ধরা, বিকেলে বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে গোল্লাছুট খেলা ইত্যাদি
যেন ছিল রাবেয়ার নিত্যকার আয়োজন। চার ভাই-বোনের মধ্যে বাবা মায়ের প্রথম সন্তান রাবেয়া। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অতি আদরের দুলালী মেয়ে হয়েই বড় হয়েছেন আদরে-আহ্লাদে, কবিতার ভাষায় যেমন বলা আছে- পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশীতে বিষম খেয়ে// আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।
বাবা মোহাম্মদ আলী হোসেন মোল্লা একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্তমানে স্থানীয়
আওয়ামী লীগ নেতা। পিতা মোহাম্মদ আলী হোসেন মোল্লা প্রথম শ্রেনীর একজন ঠিকাদার
মা জুবায়েদা হোসেন গৃহিনী। রাবেয়া
১৯৯৩ সালে মাটিভাঙ্গা সরকারি উচ্চ
বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৫ সালে ভান্ডারিয়া মজিদা বেগম মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এইচএসসি
পড়াকালীন সময়ে রাবেয়া ফুপুর বাড়িতে থেকে হয়েছেন স্নেহধন্য। এরপর চট্টগ্রাম এম ই এস কলেজ থেকে স্নাতক ও মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
স্কুল ও কলেজে পড়াকালীন সময়ে বিভিন্ন রকম খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে গালর্স গাইড ও স্কাউটেরও সাথে জড়িত ছিলেন। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে অর্জন করে নিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের পুরষ্কার। এভাবেই নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি নানামুখী কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন মননশীল ও বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হিসেবে।
২০০১ সালে মাস্টার্স পাশের পর জাতীয় পত্রিকা দৈনিক ইওেফাক এবং কিছুদিন পরে আরেকটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা The New Nation” এর প্রশাসনিক বিভাগে চাকরী করেছেন। ২০০২ সালে পরিবারিক আয়োজনে মহা ধুমধামে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন মুহাম্মদ তাহের চৌধুরী বাপ্পীর সাথে। জনাব চৌধুরী
একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বহুজাতিক কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকতা৷ রাবেয়ার শ্বশুরবাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানাধীন রণকেলী গ্রামে তবে বর্তমানে স্বামীর সাথে ঢাকায় বসবাস করছেন।
সংসার, চাকরি নিয়ে করপোরেট জীবনে ব্যস্ততম সময় ও রুটিনমাফিক সামাজিকতা।বড় মেয়ের জন্মের পর চাকরী ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি গৃহিণী হিসেবে সংসার জীবন শুরু করেন একদম নতুনভাবে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে শুরু করা সেদিনের সংসারে রাবেয়া আজ তিন মেয়ের ভাগ্যবতী জননী। দুরন্ত শৈশব পেরিয়ে জীবনের এতগুলো বছরে কতো পড়াশোনা, কতো খেলাধুলা, কতো পুরষ্কার, কতো স্মৃতি, কতো আহ্লাদীপনা; পড়াশোনা শেষে চাকরি, চাকরি বাদ দিয়ে পুরোপুরি গৃহিণী, সন্তানদেরকে বড় করা এই ছোট্ট জীবনে কতো কিছুই না সফলভাবে সম্পন্ন করলেন রাবেয়া সুলতানা আঁখি!
সন্তানেরা বড় হলে সাংসারিক নিয়মিত কাজের পরে নিজের জন্য মেলে একটুকরো অবসর।এই অবসর সময়টুকু তিনি ঘুমিয়ে অথবা অলসতা করে অপচয় করতে পারতেন। কিন্তু স্কাউট আর নানামুখী সৃজনশীল কাজে একদা জড়িত থাকা রাবেয়া জানেন সময়ের মূল্য কতো। মহামূল্যবান সময় অপচয় না করে কিভাবে গঠনমূলক কাজে লাগানো যায় এমন চিন্তা থেকেই তিনি একদিন মনের অজান্তে ফিরে গেলেন ধুসর হয়ে আসা সোনালী শৈশবে। বন্ধুদের নিয়ে কতশত চড়ুইভাতি করেছেন, প্রায় প্রত্যেকটা চড়ুইভাতিতে অবধারিতভাবে রান্নার দ্বায়িত্ব এসে পরতো রাবেয়ার ঘাড়ে। সেই ছোট্ট কাঁধে সেদিন খেলাচ্ছলে রান্নার গুরু দ্বায়িত্ব বহন করাটাই যে এতদিন পরে এসে রাবেয়ার জীবনে প্রভাব ফেলবে তুমুলভাবে তা কি কেউ কোনদিন ভেবেছিল! স্বপ্নেও হয়তো এমনটা ভাবেনি কেউ।
অবসর সময়টুকু কাজে লাগিয়ে কিভাবে নিজেকে পুনর্গঠন করা যায় বসে বসে ভাবছেন রাবেয়া। তিনি অনুভব করলেন মনের মধ্যে একটা সুপ্ত বাসনার উষ্ণতা। সেই সুপ্ত উষ্ণতা টুকুর প্রতি গভীর মনযোগ দিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন এই বাসনা সুপ্ত নয় বরং বয়ে চলেছে নিজের ভিতরে দুর্বিনীত নদীর মতোন। ফলে কোনরকম দ্বিতীয় চিন্তাভাবনা ছাড়াই তিনি শুরু করলেন পুরাতন পথে নতুন করে পথচলা। শৈশব ও কৈশরের সেই পুরাতন ও সুপ্তবাসনা জাগ্রত হওয়াটাই ছিল রাবেয়ার রন্ধন শিল্পী হয়ে ওঠার টার্নিং পয়েন্ট।
অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে রাবেয়া দেখলেন,
স্বাস্থ্যগত বিষয় চিন্তা করে মা-বাবা পারত তাকে বাহিরের খাবার খেতে দিতেন না। এমনকি তিনি নিজেও বাচ্চাদেরকে কখনো বাইরের খাবার দেননি। সংসার জীবনে স্বামীর অনুপ্রেরণায় সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে চিপস, রুটি, বিস্কুট থেকে শুরু করে প্রায় সব খাবারেই নিজের হাতে তৈরী করে খাওয়াতেন। বাপের বাড়ি পিরোজপুর আর শ্বশুড় বাড়ি সিলেট অঞ্চলে হওয়ায় দুই অঞ্চলের রান্নার স্বাদের ভিন্নতা রপ্ত করতে হয়েছে। এমনকি নিঁখুত রাধুনী হিসেবে বাবার বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি থেকে প্রশংসা পেয়েছেন সমানতালে। কলেজে পড়াকালীন নিতান্তই কৌতুহল বশত সংগ্রহ করেছিলেন
সিদ্দিকা কবীরের রেসিপি বই। এছাড়াও টিভিতে বিভিন্ন সময়ে সিদ্দিকা কবীর, কেকা ফেরদৌসী, লবী রহমান, রহিমা আক্তার রীতা, আলপনা হাবীব ও কল্পনা রহমান প্রমুখদের রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো তিনি আগ্রহভরে দেখতেন। রাবেয়া যতই অতীত স্মৃতি রোমন্থন করছেন ততই ভালো লাগছে আর আত্মবিশ্বাসের পারদ উপরে উঠছে। হঠাৎ ফিরে পাওয়া রাবেয়ার এই আত্মবিশ্বাসের পালে এসে দোলা দিলো মা, শাশুড়ী ও ফুপুর কাছে শেখা ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন রকম খাবারের রান্না, পিঠাপুলি আর নানান রঙের নানান স্বাদের আচারগুলো। রাবেয়া হয়ে উঠলেন নারী উদ্যোক্তা ও রন্ধনশিল্পী।
শুধুমাত্র কয়েকটি রেসিপি বই অনুসরণ করে, টিভিতে রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে কিম্বা মা, খালাদের কাছে অপ্রাতিষ্ঠানিক রান্না শিখে উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেননি রাবেয়া। তিনি ইতোমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রান্না বিষয়ক বেশকিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। বেকারী এন্ড পেস্ট্রির উপরেও কোর্স করেছেন। রন্ধন শিল্পের প্রতি তুমুল আগ্রহ দেখে স্বামী তাহের চৌধুরীর পরামর্শ দেন রান্নার জগতে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল কালিনারী ইনস্টিটিউট (আইসিআই) থেকে আধুনিক কিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্রী হিসেবে অধ্যয়নরত আছেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা আর নিজের কাজের প্রতি শতভাগ নিবেদিত হয়ে সফলভাবে এগিয়ে চলছেন রাবেয়া সুলতানা আঁখি। সফলতার স্বাক্ষর সরুপ তিনি ইতোমধ্যে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে রান্না বিষয়ক বেশকিছু অনুষ্ঠান করছেন। বেশ কয়েকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্র পত্রিকায় রেসিপি লিখেছেন নিয়মিত।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী হাসিনা আনছার সম্পাদিত ঐতিহ্যবাহী রান্নাঃ সেরা ১০০ রেসিপি বইয়ে তার একটি রেসিপি স্থান পেয়েছে। রন্ধন শিল্পকে ভালবেসে ও কেন্দ্র করেই নারী উদ্যোক্তা ও আলোকিত রন্ধনশিল্পী রাবেয়া সুলতানা আঁখি জীবনের বাকি পথটুকু পাড়ি দিতে চান স্বমহিমায়।