নীরব ঘাতক “ওথেলা সিনড্রোম”

Share on Facebook

১৬০৪ সাল। প্রথম মঞ্চস্থ করা হয় উইলিয়াম  শেকসপিয়রের নাটক ‘ওথেলো’। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল ‘ওথেলো’ যে তার স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে থাকত সবসময় এবং ধীরে ধীরে এই ভয়ের পরিণতিটা গিয়ে ঠেকল সন্দেহে। তার স্ত্রী ছিল অত্যন্ত রূপবতীদের একজন। সে আস্তে আস্তে তার স্ত্রীকে অসতী হিসেবে সন্দেহ করতে থাকলেন। মূলত নাটকের কাহিনীটা শর্টকার্টে এরকমই ছিল। আর গল্পের শেষে ওথেলোর হাতেই মৃত্যু হয়েছিল তার স্ত্রীর। শেকসপিয়রের এই গল্পের ঘটনাটা শুধুই একটি গল্প নয়। এটা ভয়ানক একটি রোগ। শেকসপিয়রের নাটকের সঙ্গে মিল রেখেই এর নাম রাখা হয়েছিল ‘ওথেলো সিনড্রোম’ বেশিরভাগ সময় পুরুষরা এই রোগে আক্রান্ত হয়। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে শুরু হয় সন্দেহ। নেশাগ্রস্তরা সহজেই এই রোগে আক্রান্ত হয়। একপর্যায়ে স্ত্রীর জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। এমন ঘটনা এখন ঘরে ঘরে।

সঙ্গী/সঙ্গিনী অন্যের দিকে তাকাচ্ছে বা অন্যের প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছে এরকম অভিযোগ তুলা। সঙ্গীর আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলা। ফোন কল যেমন ভুল নম্বর বা অচেনা নম্বর থেকে আসা কল বা অন্য যেকোনো ধরনের যোগাযোগের ব্যাপারে অনুসন্ধান। হ্যা এসব ই এই নীরব ঘাতক ওথেলো সিনড্রোম এর লক্ষন।

বর্তমানে শুধু সন্দেহের কারণেই ভেঙে যাচ্ছে হাজারো সংসার। আর অযাচিত সন্দেহপ্রবণ এই রোগটির নাম ওথেলো সিনড্রম।একে প্যাথলজিক্যাল জেলাসি ও বলা যেতে পারে । এর আর এক নাম ‘ওথেলো সিনড্রম’ বা মনের সন্দেহ। এমন রোগে আক্রান্ত হলে দাম্পত্য সম্পর্ক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। বিষময় হয়ে ওঠে পারিবারিক জীবন।

 

একটি জরিপে দেখা গেছে, ওথেলো সিনড্রম রোগে পুরুষেরা মহিলাদের তুলনায় বেশি ভুগে থাকেন। মহিলা ও পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার আনুপাতিক হার ১ : ৩.৭৬)। গবেষণায় দেখা গেছে, প্যাথলজিক্যাল জেলাসি কয়েকটি প্রাথমিক রোগের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারে।

এ ধরনের রোগীদের ১৭-৪৪ শতাংশের সঙ্গে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া, ৩-১৬ শতাংশের সঙ্গে ডিপরেসিভ ডিজঅর্ডার, ৩৮-৫৭ শতাংশের সঙ্গে নিউরোসিস এবং পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, ৫-৭ শতাংশের কারণে অ্যালকোহলিজম, ৬-২০ শতাংশের ক্ষেত্রে অর্গানিক ডিজঅর্ডার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্যাথলজিক্যাল জেলাসির কারণে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। ব্রিটেনে ব্রডমুর হাসপাতালে ভর্তিরত ঘাতক রোগীদের ওপর পরিচলিত এক গবেষণা রিপোর্টে ড. মোয়াট দেখিয়েছেন, এদের মধ্যে ১২ শতাংশ নারী এবং ১৫ শতাংশ পুরুষ প্যাথলজিক্যাল জেলাসিতে আক্রান্ত ছিলেন।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, জেলাসি রোগী কর্তৃক শারীরিক জখমের মাত্রাও উল্লেখযোগ্য হারে অনেক বেশি। এমনও দেখা গেছে, ক্রমাগত তীব্র সন্দেহের জ্বালা সইতে না পরে অনেক নিরপরাধ সঙ্গী আত্মহত্যার পথও বেছে নেন।

ওথেলো সিনড্রম রোগে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে কৌশলের সঙ্গে মূল্যায়ন করতে হবে। কতটুকু অমূলক বিশ্বাস রোগী ধারণ করেন, কি পরিমাণ ক্রোধ বা রাগ রোগী বহন করছেন। রোগীর ভেতর প্রতিশোধপরায়ণ মনোবৃত্তি থাকলেও সতর্ক হতে হবে।

রোগী সঙ্গীকে বিপর্যস্থ করে তোলেন কি না তা যাচাই করে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে সঙ্গীকে কৌশলে এবং ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

সাধারণত এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করেন না, তিনি রোগে আক্রান্ত। তাই তিনি ডাক্তারের শ্মরণাপন্ন হতে চান না। এক্ষেত্রে প্যাথলজিক্যাল বা ওথেলো সিনড্রম রোগের রোগীদের চিকিৎসা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, রোগী মনেই করেন না যে, তিনি কোনো রোগ ধারণ করছেন। ফলে চিকিৎসার যে কোনো উদ্যোগই তার কাছে অনাধিকার চর্চা ও অন্যায় আচরণ বলে মনে হয়।

এক্ষেত্রে স্ত্রী অর্থাৎ মেয়েটি যদি অসুস্থ হন তবে মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে মেয়েকে বুঝিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি স্বামীর প্রধান কাজ হবে, স্ত্রীকে এ রোগ সম্পর্কে বোঝানো। বিফল হলে কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে চিকিৎসকের শ্মরণাপন্ন হতে হবে।

যদি রোগটি প্রকৃতই দৃঢ়ভাবে অমূলক বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠে, তবে অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। যাদের আত্মবিশ্বাস কম কিংবা ব্যক্তিত্বের সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে ডিলুশনাল ডিজঅর্ডার বা প্যাথলজিক্যাল জেলাসিটি ওভার ভেল্যুড আইডিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা তা যাচাই করে দেখতে হবে।

ওথেলো সিনড্রোম আক্রান্ত রোগীরা নিজের সন্দেহের কথাগুলো অন্যের কাছে বলে পরামর্শ চান। কিন্তু যাকে তিনি বলছেন, তার জন্য তিনি কতটুকু ইতিবাচক হবেন তা কিন্তু তিনি ভাবছেন না। ফলে যিনি শুনছেন তিনি তার কথায় বিশ্বাস করে ভ্রান্ত পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ফলে রোগীও সেই পরামর্শ গ্রহণ করে নেতিবাচক আচরণ করেন তার সঙ্গীর সঙ্গে। এক্ষেত্রে বন্ধু-বান্ধব-পরিবার-সবাইকে গঠনমূলক পরামর্শ দিতে হবে। কারণ, একটি পরামর্শই ভেঙে দিতে পারে সাজানো সংসার।

চিকিৎসকরা বলছেন, ‘ওথেলো সিনড্রোম’ চিকিৎসা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। চিকিৎসক স্ত্রী ও স্বামী দুজনের সঙ্গে পৃথক পৃথক কথা বলেন এবং তাদের কথা শোনেন। দাম্পত্য জীবনের বিস্তারিত বিবরণ জানাটা অপরিহার্য। রোগীর বিশ্বাসের ভিত্তি এবং স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে হবে। রোগীকে বিশেষ মাত্রায় অ্যান্টি সাইকোটিক ওষুধের পাশাপাশি ‘বিহেভিয়ার থেরাপি’ প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। রোগীর অন্য কোনো অসুখ আছে কিনা, তাও ভালোমতো দেখতে হবে।

এ রোগে আক্রান্ত পরিবারগুলোর রোগীর সন্দেহের মাত্রাটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে তা প্রমাণ করার জন্য রোগী বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা করে থাকে। এতে সঙ্গীর নানা ধরনের সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। অভিভাবকদের কেউ যদি বুঝতে পারেন, এটা এক ধরনের রোগ তবে এ ধরনের সমস্যার কিছুটা হলেও লাঘব হয়।

মূলত ঝামেলাটা হয়েই থাকে ভুল বোঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে। মা-বাবাও বুঝতে পারেন না, তার সন্তান অসুস্থ। এক্ষেত্রে সামজিক সচেতনতা বা ক্রিয়েশন অব অ্যাওয়ারনেস বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা যদি ১০০ লোকের কাছেও এ রোগের তথ্য জানাতে পারি, এর মধ্যে ২ জনও যদি সামজিকভাবে সচেতন হয়, তাহলে কিন্তু কিছুটা হলেও এ সমস্যার সমাধান হবে।

এদিকে এ বিষয়ে মামলা হলে আইনজীবী যদি বুঝতে পারেন যে, রোগী অসুস্থ বা স্বামী যদি দাবি করেন যে, তার স্ত্রী মানসিকভাবে অসুস্থ তবে আইনজীবীর প্রথম কাজ হবে, তার সত্যতা যাচাই করা। এক্ষেত্রে তার উচিত, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তার সত্যতা যাচাই করে আদালতে রিপোর্ট পেশ করা। এক্ষেত্রে স্বামী যেটা করতে পারেন, সেটা হল কেন তার স্ত্রী মানসিক রোগী এর কারণগুলোও আদালতে উপস্থাপন করতে হবে।

এক্ষেত্রে কারো যদি সন্তান থাকে, তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। মা-বাবা অসুস্থ হলে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যে মানসিক পরিবেশ দরকার হয়, তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এতে শিশুটির মন মরে যায়। যখন সন্তান অনবরত দেখছে, তার বাবা-মায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া, কিংবা ঘাত-প্রতিঘাত চলছে তখন বাড়ন্ত শিশুটি মানসিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এর পরিণতিতে সে ড্রাগ এবং ক্রাইম জগতে প্রবেশ করতে পারে। অথবা নিজেই মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। সন্তানের সুস্থ বিকাশের জন্য ও মননশীলতার জন্য সামাজিক বন্ধন, মমতা ও ভালোবাসা জরুরি।

যদি উভয় পক্ষ থেকে বনিবনা না হয় তাহলে দম্পতিরা ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। যদি তারা ভাবেন, ডিভোর্স হয়ে গেলে তারা সুখী হবেন, তবে এক্ষেত্রে সন্তানটিকে নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। সন্তান কার কাছে থাকবে? এ অবস্থায় সন্তান অরক্ষিত অবস্থায় থাকে। এক্ষেত্রে সন্তানকে প্রশ্ন করতে হবে, সে কার কাছে থাকতে চায়। যদি দেখা যায়, মায়ের কাছে থাকতে চায়। কিন্তু মা রোগী প্রমাণিত হয়, তবে তার কছে রাখা নিরাপদ না। স্বামী যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, তার স্ত্রী অসুস্থ সেক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা হবে, তাকে সুস্থ করা কিংবা শিশুর অবিভাবকত্ব বাবাকে প্রদান করা। এক্ষেত্রে বাবা সুস্থ থাকলে বাবার কাছে রাখাই নিরাপদ।

 

কথা গুলো বলছিলেন
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরে বাংলা নগর ঢাকার বিশেষ মনোরোগ একজন চিকিৎসক।

 

Leave a Reply