পর্যটনের জন্য স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠনসহ ৭ দফা দাবি
Tweet
গতকাল ১২ জুন সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে “বাজেট ভাবনাঃ করোনাকালে বিপর্যস্ত পর্যটন খাত এবং পর্যটন শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের সুরক্ষায় করণীয়” – শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম এন্ড হোটেলস ওয়ার্কার্স-এমপ্লয়িজ ফেডারেশন কর্তৃক আয়োজিত এই আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোখলেছুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার দেব, বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম সাগরসহ পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ফেডারেশনের যুগ্ম আহবায়ক খালেকুজ্জামান লিপন এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুগ্ম আহবায়ক ফারহানা ইয়াসমিন।
অন্যান্য শিল্পের সাথে পর্যটন শিল্পের পার্থক্য তুলে ধরতে বক্তারা বলেন সরকার যেসকল শিল্পের জন্য প্রণোদনা দিচ্ছে সেইসব শিল্পের দ্বারা উপার্জিত অর্থের সিংহভাগই আবার দেশের বাইরে চলে যায় সংশ্লিষ্ট পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে। কিন্ত পর্যটনের মাধ্যমে আয়কৃত বৈদেশিক মূদ্রার শতভাগই দেশের তহবিলে যুক্ত হয়। সরকার পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পর্যটন শিল্প হতে পারে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন এবং শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীদের কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস। তাই পর্যটন বিকাশে সরকার এই শিল্পের দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিক-কর্মচারীদের সুরক্ষায় বাজেট সংশোধন করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিবেন বলে নেতৃবৃন্দ প্রত্যাশা ব্যাক্ত করেন।
প্রাকৃতিক বৈচিত্রের প্রাচুর্যতায় বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থেকেও পরিকল্পিত উপায়ে বিশ্বের অনেক দেশ পর্যটনকে জাতীয় আয়ের প্রধান উৎসে পরিণত করেছে। মোট জাতীয় আয়ের সিঙ্গাপুরের ৭৫ শতাংশ, তাইওয়ানের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ পর্যটনের অবদান।
২০১৭ সালেই বিশ্ব জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ করোনার আঘাতের পূর্ব পর্যন্ত যা ছিল দ্রুত বর্ধনশীল। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডাব্লিউটিটিসি) এর গবেষণা মতে পর্যটন শিল্প থেকে বিশ্ব ২০২০ সাল হতে বাৎসরিক প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হতো যা যেকোন বড় শিল্পের আয়ের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্বময় পর্যটন শিল্পের বিকাশের এই গতি করোনা মহামারিতে মারাত্মকভাবে হোঁচট খেয়েছে। ডাব্লিউটিটিসি বলছে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটকরা বাংলাদেশ ভ্রমণ করবে যা দেশের মোট জিডিপিতে ১০ শতাংশের বেশি ভূমিকা রাখবে। করোনা সংক্রমণের পূর্বে ২০১৯ সালেও বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল ৭৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
বক্তারা আরও বলেন, পৃথিবীব্যাপী বিমান পর্যটনশিল্পের উপখাত পরিবহনের একটি অংশ মাত্র। অথচ বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অভিভাবক হিসাবে কাজ করছে বিমান। ফলে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নামে বরাদ্দের ৮০ শতাংশের বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র বিমানের পিছনে। ২০২০-২১ বাজেটে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় মোট ৩৬৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়। বরাদ্দকৃত অর্থের ২৯৮৪ কোটি টাকা ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে। ব্যয়িত অর্থ বিমান আর পর্যটন কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ ছাড়া পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে কোথায় ব্যয় করা হয়েছে তা দৃশ্যমান নয়। পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট কোন খাতের বিনোয়গকারী কিংবা শ্রমিক-কর্মচারী কেউ এক টাকাও সহায়তা পায়নি অথচ করোনায় এখন পর্যন্ত পর্যটন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে মাত্র ৪০৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ পর্যটন খাতের প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীদের যারা বেতন ছাড়া বাধ্যতামূলক ছুটিতে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে তাদের সুরক্ষায় এই বাজেটেও কোন ব্যবস্থা নাই। বিমানের ঘাটতি পুরণে বাজেট থেকে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয় সেই তুলনায় পর্যটনের অন্যান্য খাতগুলি থাকে উপেক্ষিত। অতএব, পর্যটন খাতের সামগ্রিক উন্নয়নে পর্যটনের জন্য স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠনের কোনো বিকল্প নাই বলে দাবি করেন বক্তারা।
ফেডারেশনের আহবায়ক মোহাঃ রাশেদুর রহমানের সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব আহসান হাবিব বুলবুলের সঞ্চালনায় অনুষ্টিত
আজকের আলোচনা অনুষ্ঠান। পর্যটন খাতের ৪০ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী এবং তাদের উপর নির্ভরশীল আরও প্রায় ২ কোটি জনসংখ্যার জীবন জীবিকা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পর্যটন খাতকে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি প্রধান ভিত্তি হিসাবে গড়ে তুলতে বক্তারা সম্মিলিত ভাবে নিম্নোক্ত সাতটি দাবি তুলে ধরে-
১) “বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়” থেকে আলাদা করে পর্যটনের জন্য স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করা।
২) পর্যটন খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের শ্রম অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান শ্রম আইনের শিল্প তালিকায় উপখাতসহ পর্যটন শিল্পকে যুক্ত করা এবং পর্যটন খাতে শ্রম আইনের বাস্তবায়ন করা। পর্যটন কেন্দ্রীক জেলাসমূহে শ্রম আদালত, শ্রম পরিচালক ও শ্রম পরিদর্শকের দপ্তর চালু করা।
৩) মজুরি কাঠামো এবং বাজারমূল্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে মজুরি পুণঃনির্ধারণের পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট করা।
৪) পর্যটন খাতে নিয়োগের ক্ষেত্রে হোটেল-রেঁস্তোরা আইন ২০১৪ এর বাস্তবায়ন এবং বিদেশী বা স্বজনপ্রীতি নয় পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন বাংলাদেশীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রধিকার দেওয়া।
৫) করোনায় চরমভাবে বিপর্যস্ত পর্যটন খাতের পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা এবং পর্যটন শ্রমিকদের আর্থীক সহায়তা দিতে বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ দেওয়া। করোনার টিকা প্রদানে সরাসরি পণ্য এবং সেবা উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া।
৬) যেকোন দুর্যোগে পর্যটন শিল্প ও শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের অবসরকালিন সময়ের নিরাপত্তায় ভবিষ্যত তহবিল গঠন করা।
৭) রাষ্ট্রের সকল অবকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় পর্যটন বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা।