রন্ধনশালার আলোকিত শিল্পী রেজওয়ানা
Tweet
রন্ধন জগতে একজন উদীয়মান ও সম্ভাবনাময়ী শিল্পীর নাম উম্মে রেজওয়ানা। রেজওয়ানা একাধারে রন্ধনশিল্পী ও আলোকিত নারী উদ্যোক্তা। তিনি নার্সারি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত খিলগাঁও কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি পড়েছেন খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন তারা বসবাস করতেন খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকায়। এরপরই মায়ের আকস্মিক অসুস্থতাজনিত অনিবার্য কারণে চলে যান নানার বাড়ি মানিকগঞ্জ। সেখানেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এসএসসি পযর্ন্ত পড়াশোনা করেছেন। ২০০৩ সালে তিনি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাশ করেন।
বিদ্যানুরাগী ও ডানপিটে স্বভাবের রেজওয়ানা পড়ালেখা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছিলেন সমান পারদর্শী। স্কুলে যেকোন বার্ষিক অনুষ্ঠান মানেই রেজওয়ানার অনিবার্য উপস্থিতি। এতো সব দুরন্তপনা, খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার পরেও তিনি নিয়মিত পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকেননি। অন্যান্য প্রতিযোগিতার মতো পড়াশোনার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন বরাবরই উজ্জ্বল একটি নাম। বার্ষিক পরীক্ষায় কখনও ক্লাসের রোল নাম্বারে হয়তো প্রথম হতে পারেননি তবে দুই থেকে কখনো পিছিয়েও পরেননি। জীবনের ঊষালগ্নেই একাধিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন, অনেকরকম সহপাঠীদের সাথে মেলা মেশার সুযোগ পেয়ে রেজওয়ানা হয়েছে উঠেছেন একজন অনন্যসাধারণ নারী। রাজধানী এবং জেলা শহরের জীবন ও বৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ করতে পেরে তিনি অন্য আর দশজন ছাত্রের চেয়ে প্রাজ্ঞ ও বিবেচনাপ্রসূত হয়ে উঠেছেন কৈশোরকালের শুরুতেই। এজন্যই ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে বিখ্যাত পরিচালক এস এ হক অলীকের পরিচালনায় তিনটি নাটকে অভিনয় করেও পরিবারের সম্মতি না পেয়ে ইতি টেনেছেন অভিনয় জীবনের।
উম্মে রেজওয়ানা ২০০৫ সালে ঢাকার বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজে থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশের পরেই ২০০৬ সালে অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। ২০০৭ সালে স্বামীর ইচ্ছা ও পরামর্শে বেকিং এবং কনফেকশনারি’র উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রথম প্রশিক্ষণেই কুকিং এবং বেকিং এর উপর যথেষ্ট আগ্রহ জন্মে যায়। ফলে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে তিনি বিভিন্ন সময়ে রান্না বিষয়ক আরও অনেক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রায় দুই বছর ধরে রান্না বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও পড়াশোনা শেষে প্রবেশ করেন উদ্যোক্তা জীবনে। জীবনের অর্জিত জ্ঞান ও মননশীলতার সমন্বয়ে ২০০৯ সালে ছোট্ট পরিসরে শুরু করেন হোম মেড খাবার সরবরাহের ব্যবসা।
শৈশব থেকেই যদিও জীবনের দশদিক সামলে চলতে পারঙ্গম রেজওয়ানা তবুও ছোট বাচ্চা, সংসার, পড়াশোনা এবং ব্যবসা সবমিলিয়ে হিমশিম অবস্থা। এই অবস্থায় তিনি প্রতিজ্ঞা করেন সন্তানের যত্নে কোনো অবহেলা করা যাবে না একই সাথে অনার্স পাশও করতে হবে। সংসারের অন্যান্য কাজকর্ম যথাসম্ভব সহজ করে নেওয়ার চেষ্টা করে তিনি আপাতত বিরতি টানলেন নিজের ব্যবসায়। সন্তানের যত্নে সাধ্যমতো নিবেদিত হয়ে অল্প যতটুকু সময় হাতে পেলেন তা ব্যবহার করলেন নিজের পড়াশোনা আর সাংসারিক টুকটাক কাজ-কর্মের পিছনে। এভাবেই ২০০৯ সালে যশোর সরকারি মহিলা কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও ২০১০ সালে যশোর এম এম কলেজ থেকে সফলভাবে মাষ্টার্স সম্পন্ন করেন রেজওয়ানা।
ইতোমধ্যে সন্তানও কিছুটা বড় হয়েছে আবার নিজেরও পড়াশোনা শেষ হয়েছে ফলে তিনি ফিরে এলেন আবার উদ্যোক্তা জীবনে।২০১৩ সালে ফিরে এসে তিনি সেখান থেকেই শুরু করলেন যেখানে ছেড়ে গিয়েছিলেন ২০০৯ সালে। তুমুল উদ্দীপনা নিয়ে পুনরায় শুরু করার পরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন আরও নারী উদ্যোক্তা তৈরীতে। শুরু করলেন প্রশিক্ষণ প্রদান। নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান ও ব্যবসায়িক ব্যস্ততার ফাঁকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রান্না বিষয়ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন।
২০১৯ সালে কুকিং ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত পিঠা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যশোর থেকে নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় আসেন মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে। একই বছর ডিপ্লোমা মিষ্টি তৈরি লড়াইয়ে যশোর থেকে নির্বাচিত হন। এতে করে তার রন্ধনশিল্পের প্রতি ঝোঁক আরও বেড়ে যায় বহুগুণে।
২০২০ সাল থেকে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস সংক্রমণে সারাবিশ্ব থমকে গেছে। এমন সময় তিনি একটি রান্না বিষয়ক ফেসবুক পেইজ খোলেন। এই পেইজ থেকে কেক,কনফেকশনারি আইটেম ও ডেজার্ট তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত। এভাবেই ঘরে বসে থেকেই নারীদেরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে অবদান রেখে যাচ্ছেন। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি তিনি অন্য নারীদেরও স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলছেন যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
আলোকিত রন্ধনশিল্পী ও নারী উদ্যোক্তা উম্মে রেজওয়ানা পছন্দ করেন দেশ-বিদেশ ঘুরতে, নিত্য নতুন রান্না শিখতে ও রান্না করে পছন্দের মানুষদেরকে খাওয়াতে। মানবতার জন্য কল্যাণমূলক যেকোন কিছুই শিখতে ও চর্চা করতে ভালো লাগে। রান্না ছাড়াও মেকআপ করতে ভালবাসেন তিনি। নিতান্তই শখের বসে মেকআপ এর উপর একটা শর্ট কোর্স করেছেন তিনি।
রুপালি মটরস নামে উম্মে রেজওয়ানার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। ২০১৯ সালে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী হিসাবে সেরা মহিলা করদাতা ২০১৯ পদক পেয়েছেন। রুপালী মটরসের তুলনায় তাঁর রন্ধন বিষয়ক ব্যবসা হয়তো বড় নয় তবুও তিনি নিজেকে একজন রন্ধন শিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এখন ক্ষুদ্র পরিসরে চললেও ভবিষ্যতে চলার পথ আরও প্রশস্ত করবার ইচ্ছে পোষণ করেন উম্মে রেজওয়ানা।