রন্ধনশালার আলোকিত শিল্পী মুমু
Tweet
নাজিয়া ইসলাম মুমু বর্তমানে হেড অব এইচ আর হিসেবে কর্মরত আছেন নিফটি কোডার্স নামক একটি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিতে। সম্প্রতি তিনি একটি ই-কমার্স সাইট অনলাইন গ্রোসারি শপেও বিনিয়োগ করার মাধ্যমে একজন পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। তবে এতো সবকিছু ছাপিয়ে নিজেকে একজন রন্ধন শিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাধীনতার সুখ বেশি অনুভব করেন তিনি। নাজিয়া ইসলাম মুমুর মনোজগত জুড়ে যে স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন্য উশখুশ তা এনে দিয়েছে তার রন্ধন শিল্পী জীবন। বেকিং নিয়ে তাঁর একটি ফেসবুক পেইজ আছে মুমু’স ওয়ান্ডার বেক’স নামে।
নাজিয়া ইসলাম মুমু’র জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায়। দুই বোনের মধ্যে মুমুই বড়। শৈশব থেকেই পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী মুমু দেশের অন্যতম সেরা ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে ও’লেভেল এবং এ’লেভেল পাশ করেন ২০০২ এবং ২০০৪ সালে। এ’লেভেল পড়াকালীন সময় নিজের স্কুলেই শিক্ষকতা শুরু করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
এ’লেভেল পাশ করার পর টিভিতে কাজ করার সুপ্ত বাসনা থেকে নিউজ প্রেজেন্টেশন কোর্স সম্পন্ন করেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশন (বিসিডিজেসি) থেকে। সফলতার সাথে কোর্স সম্পন্ন করলেও টিভিতে কাজ করা আর হয়ে ওঠনি হঠাৎই আগ্রহে ভাটা পড়ে যাওয়ায়। এরপর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) থেকে ব্যবসায়ে প্রশাসনে গ্রাজুয়েশন করেন মুমু।
স্কুল জীবন থেকেই পড়াশুনার পাশাপাশি চাকরি চালিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট সুযোগ এবং অনুপ্রেরনা পেয়েছেন মুমু। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহায়তায় অল্পবয়স থেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন ফলে তার আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়েছে কৈশোরকালেই। শিক্ষকতা করতে গিয়ে তিনি যে সম্মান পেয়েছেন কর্মক্ষেত্রে তা তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন সবসময়। একই সাথে পড়াশোনা, চাকরি ও সম্মান অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে মুমু নিজেও মানুষের প্রতি হয়েছেন যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল।
বিবিএ পড়াকালীন প্রথম বর্ষেই বিয়ে হয়ে যায় ২০০৭ সালে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভাগ্যবতী মুমু যাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছেন তিনি অসম্ভব রকমের ভালো মনের অধিকারী একজন মানুষ। যথেষ্ট উদার ও ন্যায়পরায়ণ একজন মানুষ। তিনিও মুমুর প্রতি সহযোগিতার হাত নিয়ে লেগে আছেন ছায়ার মত। যেকোনো পদক্ষেপেই তিনি মুমুকে সাহস, পরামর্শ আর সহযোগিতা করে আসছেন। তারই উৎসাহ আর অনুপ্রেরনা আজকের মুমু একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন বলে কৃতজ্ঞতা জানান স্বামীর প্রতি।
দাম্পত্য জীবনে মুমু একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তানের গর্বিত জননী। ২০১০ সালে প্রথম সন্তানের জন্ম হলে নিজের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা না করেই শিক্ষকতার চাকরিটা ছেড়ে দেন। প্রথম সন্তানের মনমতো যত্ন নিতে নিজের ক্যারিয়ারের চিন্তা ত্যাগ করতে দ্বিধাহীন নাজিয়া ইসলাম মুমু। সেই ছোট্টবেলা থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের রোজগারে স্বাবলম্বী হয়ে চলা যার অভ্যাস তিনি প্রথম সন্তানের শতভাগ সেবাযত্ন করার জন্য হয়ে গেলেন পুরোপুরি গৃহিণী। সুখী সুন্দর দাম্পত্য জীবনের সমস্ত কোলাহল নিজের সন্তানকে ঘিরে। মাতৃস্নেহের চাদরে বড় হচ্ছে সন্তান। গুটগুট করে এরুম-ওরুম তোলপাড় করে বেড়ায় সন্তান; মা মুমুর অন্য চিন্তা করবার অবকাশ মেলে না। মাতৃ মমতায় নিজের ভিতরে নিজেই পূর্ণ থেকে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে নাজিয়া ইসলাম মুমু।
২০১৫ সালে স্বামীর চাকরির পোস্টিং সুবাদে তারা সপরিবারে চলে যান ভারতের গুরগাঁও। সেখানে গিয়ে সাংসারিক কাজ-কর্মের বাইরে অবসর সময়টুকু তিনি বসে না থেকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করলেন। দেশের বাইরে গিয়েও থেমে থাকেনি মুমু। এনহ্যান্সিং আর্লি এডুকেশন প্রোগ্রাম (থ্রি.ই.পি) থেকে একটা ৬ মাসের কোর্স করার পর মুমুর শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহ আবার বেড়ে যায়। মনে মনে ভাবলেন ঢাকায় ফিরে এসে কোনো না কোনো স্কুলে আবার শিক্ষকতা শুরু করবেন। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। প্রবাস জীবন থেকে ঢাকায় ফিরে আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুল বাংলাদেশ’এ শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তিনি উমরাহ্ হজ্জ পালন করে আসেন ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালে ছোট মেয়ের জন্ম হয়। মেয়ের জন্মের মাত্র পাঁচ মাস পরেই শুরু হয় দেশব্যাপী লকডাউন। বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংক্রমণের কারণে গোটা বিশ্ব যখন থমকে গেছে ঠিক তখনই নতুন করে নিজেকে সাজিয়ে নিলেন প্রত্যুৎপন্নমতী নাজিয়া ইসলাম মুমু।
লকডাউনের সময়ে অখণ্ড অবসর। নিজেকে নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার মতো উপযুক্ত সময় এখনই। তাই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসলেন মুমু। সফটওয়্যার কোম্পানি নিফটি কোডার্স এর হেড অব এইচ আর এবং এডমিন রোলে কাজ শুরু করলেন। ই-কমার্স গ্রোসারী শপে বিনিয়োগ করে হলেন প্রতিষ্ঠানটির একজন পরিচালক। আরও কিছু করার মতো হাতে এখনো আছে কিছু সময়। কী করা যায়! নিজেকে নিজেই ছাড়িয়ে যাওয়ার তাগিদ ভিতর থেকে অনুভব করছেন প্রবলভাবে। কেউ বলেনি তবুও মুমু জানেন সদ্যোজাত কন্যা মায়ের জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছে নিশ্চয়।
লকডাউনের এই সময়ে তিনি অনলাইনে কুকিং এবং বেকিং এর উপর বেশকিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেন। এ যেনো শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ নয় বরং খুঁজে পেলেন নিজেকে তীরে ভেড়ানোর কাঙ্ক্ষিত সেই ছায়াশীতল বন্দর। বেকিং নিয়ে তার আগ্রহ সেই শৈশব-কৈশোর কাল থেকেই। শুধুমাত্র সময়ের অভাবে কখনো কোন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা হয়নি। তাই তিনি লকডাউন সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন শতভাগ। ঘরে বসে অনলাইনে বেকিং ও কুকিং বিষয়ে অনেকগুলো প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আবিষ্কার করলেন নিজের সুপ্ত প্রতিভা। নেশা পেয়ে বসলো কুকিং এবং বেকিং জগতে। পারিবারিক উৎসাহ পেয়ে তিনি একের পর এক প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে মনযোগী হলেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তার সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবারের সুনাম ছড়িয়ে পড়লো পারিবারিক গণ্ডীর বাইরে নিকট আত্মীয় ও বন্ধু মহলে। কাছের মানুষদের জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে নিজের হাতে তৈরী কেক উপহার দেওয়া শুরু করলেন। নিকট আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত জনদের উৎসাহ, আগ্রহ আর পরামর্শে তিনি একটি ফেসবুক পেইজ খুললেন মুমু’স ওয়ান্ডার বেক’স নামে। এই পেইজ থেকে বেকিং আইটেম বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু করার পর অল্প সময়ের মধ্যেই অভাবনীয় সাড়া পেয়ে মুগ্ধ নাজিয়া ইসলাম মুমু।
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যুরিজম রিসার্চ ইন্সটিটিউট’র কারিগরি সহায়তায় বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী হাসিনা আনছারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ঐতিহ্য বাহী রান্নাঃ সেরা ১০০ রেসিপি বইটি। ২৮ মে বইটির প্রকাশনা উৎসব ও বিটিআরআই কালিনারী এক্সিলেন্স এ্যাওয়ার্ড-২০২১ অনুষ্ঠিত হয়। রান্নার জগতে সাড়া জাগানো বইটিতে দেশের নামকরা রন্ধন শিল্পীদের সাথে নাজিয়া ইসলাম মুমুরও একটি সুন্দর রেসিপি স্থান পেয়েছে। স্বনামধন্য ১০০ জন রন্ধনশিল্পীর মধ্যে মুমু নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে নিজের মেধা, পরিশ্রম আর অধ্যবসায় দিয়ে। খুবই সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত নাজিয়া ইসলাম মুমু একজন নারী উদ্যোক্তা হতে পেরে গর্বিত। তিনি চান জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আত্মসম্মান বজায় রেখে মাথা উঁচু করে বাঁচতে এবং আরও সামনে এগিয়ে যেতে।