রন্ধনশালার আলোকিত শিল্পী আনোয়ারা
Tweet
১৯৭৭ সালে নড়াইল জেলার কালিয়া থানার চিত্রা নদীর পাড়ে পাটেশ্বরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আনোয়ারা পারভিন। তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামে জল ও জঙ্গলের কাব্যে। বাবা ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর মাতা গৃহিণী। সচ্ছল পরিবারের ছয় ভাই বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। পরিবারের সবার ছোট্ট হওয়ায় অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক বেশী আদর ও শাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠা।
১৯৯২ সালে এসএসসি পাশ করার পরে খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হন আনোয়ারা পারভিন। এই কলেজ থেকেই এইচএসসি ও স্নাতক পাশ করেন তিনি। পড়ালেখার সুবাদে খুলনায় এসে বসবাস করার গোড়া থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেন। প্রথমে খুলনা যুব উন্নয়ন থেকে ড্রেস মেকিং এন্ড টেইলারিং এর প্রশিক্ষণ নেন ১৯৯২ সালে। এরপর একই প্রতিষ্ঠান থেকে ব্লক বাটিকের উপরেও প্রশিক্ষণ নেন। সেই থেকে শুরু হয় তার গতানুগতিকের বাইরে পথ চলা।
সংসার জীবনে আনোয়ারা দুই সন্তানের মা; স্বামী একজন সফল ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী পতি আর ছেলেমেয়েকে নিয়ে সুন্দর দাম্পত্য জীবন সুখে পরিপূর্ণ কানায় কানায়। নিজের সন্তুষ্টি আর পরিপূর্ণতার জন্য ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি হস্ত শিল্পের উপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অর্জন করেছেন যথার্থ দক্ষতা। আনোয়ারা পারভিন বর্তমানে বিভিন্ন কারুশিল্পের কাজও করছেন তবে রন্ধনশিল্পের মাঝেই খুঁজে পেয়েছেন জীবনের ছন্দ ও কাঙ্ক্ষিত সুখের মোহনা।
ছোট বেলা থেকেই নিজেকে সুন্দর ও পরিপাটি করে রাখতে পছন্দ করেন আনোয়ারা। নিতান্তই শখের বসে বিউটি পার্লারের কাজের উপরেও নিয়েছেন প্রশিক্ষণ। কিন্তু পেশাও নেশা ভালোবাসায় বেঁধে নিয়েছেন তিনি রান্নাকে। রান্না বিষয়ক নিজের ফেসবুক পেইজ ‘CakeSta’ থেকে চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের ব্যবসা। এখানে বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন মোগলাই, ফাস্টফুড, বেকারি,কেক পেস্ট্রি, ডেজার্ট, বিরিয়ানি, পিঠা, মিষ্টি, আইসক্রিম, চাইনিজসহ বিভিন্ন দেশ বিদেশের রান্নার ক্রয়াদেশ গ্রহণ ও সরবরাহ করে থাকেন আলোকিত রন্ধনশিল্পী আনোয়ারা পারভিন।
আপনার স্বেচ্ছায় দেওয়া এক ব্যাগ রক্ত বাঁচিয়ে তুলতে পারে একজন মুমূর্ষু রোগীর জীবন। এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি ১৯৯৬ সালে হয়ে যান সন্ধানী ডোনার ক্লাব খুলনার একজন সম্মানিত সদস্য। এরপর শুরু হলো প্রতি চার মাস পরপর নিয়মিত রক্ত দেওয়া। মুমূর্ষ রোগীর মুখে হাসি ফোটানোই যেন হয়ে গেল তার একমাত্র নেশা। অসংখ্য রোগীকে রক্তদানের মাধ্যমে বাঁচিয়ে তুলতে নিবিড় অবদান রাখায় তিনি ১৯৯৯ সালে অর্জন করেন সেরা রক্তদাতা সম্মাননা আওয়ার্ড।
২০০২ সালে তিনি ‘বয়রা ডাক বিভাগীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়’এ সহকারি শিক্ষক পদে যোগদান করেন। অতিব্যস্ততম ও কোলাহলপূর্ণ রাজধানী থেকে বহুদূরে খুলনা বিভাগীয় শহরে ভালোই চলছিল চাকরির দিনগুলি। একইসাথে শিক্ষকতার চাকরি ও রান্না বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করছিলেন তিনি। আনোয়ারা পারভিন যখন-যেখানে-যেভাবে পড়ালেখা করেছেন বা চাকরি করেছেন মুলত তিনি নিশিদিন আচ্ছন্ন থেকেছেন রান্নায়। রান্নাই যেন তার পরিপূর্ণ তৃপ্তি প্রাপ্তির একমাত্র উপলক্ষ্য।
১০ বছর চাকরি করার পর ২০১২ সালে এসে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ব্যবসায়ী বাবা সারাদিন ব্যস্ততার কারণে ছেলেমেয়েদের তেমন একটা সময় দিতে পারেন না ফলে মা আনোয়ারা নিজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মগ্ন হলেন সন্তানদের সেবাযত্নে। সারাদিন টুকটাক ঘরের কাজ আর সন্তানদের সাথে খেলাধুলা সময় কাটান তিনি। একেক বিকেল একেক রকম নাশতা, একেকটা উপলক্ষ এলেই একের রকম রান্না তৈরী করে সন্তানদের খাওয়ান আনোয়ারা। নিজের হাতে রান্না করা সুস্বাদু খাবার খেয়ে আত্মীয় স্বজন প্রশংসা করে আর আনোয়ারা পারভিনের আত্মবিশ্বাসের পারদ উপরে উঠে।
ছেলেমেয়েদের সময় দেওয়ার জন্য তিনি চাকরি ছেড়েছেন। সন্তানেরা একটু একটু করে বড় হলে তিনি নিজেও এলএলবিতে ভর্তি হয়ে আবার শুরু করেন পড়াশোনা। সংসার, সন্তানাদি, পড়াশোনা এসব মিলিয়ে নিজের ব্যস্ততা বেড়েই চলছে দিনের পর দিন তবুও তিনি ভুলতে পারেন না রন্ধনশিল্পের কথা। বর্তমানে তিনি এলএলবি শেষ বর্ষের ছাত্রী। ৪৪ বছর বয়সে এসেও সংসার আর লেখাপড়ার পাশাপাশি ধরে রেখেছেন রন্ধনশিল্পের সাথে নিজের পথচলা। রন্ধনশিল্পের প্রতি অমোঘ মুগ্ধতা থেকেই তিনি সেই ১৯৯২ সাল থেকে সীমিত পরিসরে হলেও বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন মোগলাই, ফাস্টফুড, বেকারি,কেক পেস্ট্রি, ডেজার্ট, বিরিয়ানি, পিঠা, মিষ্টি, আইসক্রিম, চাইনিজসহ বিভিন্ন দেশ বিদেশের রান্না বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রদান করে আসছেন।
খৃষ্টীয় ২০১৮ সাল এখান থেকেই আড়মোড়া ভেঙে দৃপ্ত পথচলা শুরু। আনোয়ারা নতুন করে মনে করেছেন “আমরা নারী আমরা পারি” তাই তিনিসহ কয়েকজন নারী চেয়েছেন, শুধুমাত্র নারীদের দ্বারা একটি ক্লাব গঠিত হোক। তাঁদের দৃঢ় সংকল্প থেকেই সেটি সম্ভবও হয়েছে। ২০১৮ সালে খুলনার কিছু সৎ সাহসী মেধাবী পরিশ্রমী নারী দ্বারা গঠিত হয় সুন্দরবন লায়ন্স ক্লাব, খুলনা। বর্তমানে তিনি সুন্দরবন লায়ন্স ক্লাবের মেম্বারশিপ চেয়ারপারসন হিসেবে দ্বায়িত্বরত আছেন।
রান্নার জগতে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল কালিনারী ইনস্টিটিউট (আইসিআই) থেকে ফুড আর্ট এন্ড প্রেজেন্টেশনের উপর একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন আনোয়ারা পারভিন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী হাসিনা আনছার সম্পাদিত ঐতিহ্যবাহী রান্নাঃ সেরা ১০০ রেসিপি বইয়ে তার একটি রেসিপি স্থান পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রন্ধন জগতে বিশেষ অবদান রাখায় তিনি বাংলাদেশ ট্যুরিজম রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) থেকে পেয়েছেন ‘বিটিআরআই কালিনারি এক্সিলেন্স এ্যাওয়ার্ড-২০২১’। রন্ধন শিল্পকে ভালবেসে ও কেন্দ্র করেই নারী উদ্যোক্তা ও আলোকিত রন্ধনশিল্পী আনোয়ারা পারভিন জীবনের বাকি পথটুকু তিনি পাড়ি দিতে চান স্বমহিমায়।