গরুর মাংসে না নয়, পরিমিতকে হ্যাঁ বলুন
Tweet
সাজেদা কাশেম জ্যোতি,
পুষ্টিবিদ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি, বারডেম
কোরবানির ঈদের এই সময়ে মুসলমানদের ঘরে ঘরে গরু-ছাগলের মাংস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। অনেকের ধারণা, গরুর মাংস ক্ষতিকর খাবার, তাই এড়িয়ে চলা উচিত। বিশেষ করে এটি কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
অথচ সঠিক তথ্য হলো, গরুর মাংসের অনেক উপকারী দিকও আছে। পরিমিত পরিমাণে সঠিকভাবে গরুর মাংস খেলে যে পরিমাণ পুষ্টি মেলে, তা সমপরিমাণ অন্য খাবার থেকে পাওয়া দুষ্কর।
কতটুকু খাবেন দৈনিক গরুর মাংস খাওয়ার নিরাপদ মাত্রা হলো তিন আউন্স বা ৮৫ গ্রাম। এই পরিমাণ মাংস খেলে দৈনিক ক্যালরির চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ মিলবে (তিন আউন্স মাংসে আছে ২০০ ক্যালরি এবং দৈনিক চাহিদা ২০০০ ক্যালরি)।
চর্বি ছাড়া মাংস খান গরুর মাংস চর্বি ছাড়া এবং চর্বিসহ এই দুভাবে পাওয়া যায়। গরুর শরীরের দুটি অংশে চর্বির পরিমাণ অনেক কম থাকে। একটি হলো পেছনের রানের ওপরের ফোলা অংশের মাংস, যাকে রাউন্ড বলা হয়। অন্যটি পেছনের দিকের ওপরের অংশের মাংস, যাকে সেরলয়েন বলা হয়।
তবে মাংসের বাইরে যে চর্বি লেগে থাকে সেগুলো রান্নার আগে কেটে ফেলে দিলে কোলেস্টেরলের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা যায়।
কোলেস্টেরলের মাত্রা ৮৫ গ্রাম সেরলয়েন অঞ্চলের মাংসে কোলেস্টেরলের মাত্রা ৪৭ মিলিগ্রাম এবং ৮৫ গ্রাম রাউন্ড অঞ্চলের মাংসে কোলেস্টেরলের মাত্রা ৫৩ মিলিগ্রাম। একজন সুস্থ মানুষের কোলেস্টেরলের দৈনিক নিরাপদ মাত্রা হলো ৩০০ মিলিগ্রাম এবং হৃদরোগীর জন্য ২০০ মিলিগ্রাম। সুতরাং ৮৫ গ্রাম গরুর মাংসে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিরাপদ সীমার অনেক নিচে।
পুষ্টিমান শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ৯টি পুষ্টি উপাদান আছে গরুর মাংসে। এগুলো হলো প্রোটিন, জিংক, ভিটামিন বি১২, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, নায়াসিন, ভিটামিন বি৬, আয়রন ও রিবোফ্লাভিন।
প্রোটিন পেশি গঠনে ভূমিকা রাখে, জিংক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ফসফরাস দাঁত ও হাড়ের শক্তি বাড়ায়, আয়রন পেশিগুলোতে অক্সিজেন প্রবাহে সহায়তা করে এবং ভিটামিন বি১২ খাদ্য থেকে শক্তি জোগান দেয়।
তুলনাঃ
♦ ৮৫ গ্রাম গরুর মাংস থেকে যে পরিমাণ জিংক মেলে, সেই পরিমাণ জিংক পেতে খেতে হবে ৮৫ গ্রাম ওজনের ১১ টুকরা টুনা মাছ।
♦ এই পরিমাণ আয়রনের জন্য খেতে হবে ৮৫ গ্রাম ওজনের সাত টুকরা মুরগির বুকের মাংস।
♦ এই পরিমাণ রিবোফ্লাভিনের জন্য খেতে হবে ৮৫ গ্রাম ওজনের আড়াই টুকরা মুরগির বুকের মাংস।
♦ এই পরিমাণ থায়ামিনের জন্য খেতে হবে ৮৫ গ্রাম ওজনের দুই টুকরা মুরগির বুকের মাংস।
শিশুর প্রয়োজনীয়তা বর্ধনশীল শিশু বা টিনএজারদের শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে গরুর মাংসের তুলনা নেই। শুধু শারীরিক বর্ধন নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক গঠন এবং রক্তবর্ধনেও এটি ভূমিকা রাখে।
৮৫ গ্রাম গরুর মাংসে আছে ৯-১৩ বছর বয়সী শিশুর দৈনিক চাহিদার ১২৫ শতাংশ ভিটামিন বি১২, ৯০ শতাংশ প্রোটিন, ৭৪ শতাংশ জিংক, ৪২ শতাংশ সেলেনিয়াম, ৩২ শতাংশ ভিটামিন বি৬, ৩২ শতাংশ আয়রন, ২৯ শতাংশ নায়াসিন, ২৩ শতাংশ রিবোফ্লাভিন এবং ১৬ শতাংশ ফসফরাস।
ক্যান্সার প্রতিরোধক গরুর মাংসে আছে Conjugated Linoleic Acid (CLA), যা ক্যান্সার-ডায়াবেটিস প্রতিরোধসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
মেনে চলুন কিছু নিয়ম নিয়মিত গরুর মাংস খেয়েও ঝুঁকিমুক্ত থাকা সম্ভব। এ জন্য কিছু বিষয় মেনে চলা উচিত; যেমন—
♦ খাওয়ার জন্য বেছে নিন গরুর রাউন্ড ও সেরলয়েন অঞ্চলের মাংস।
♦ মাংসের বাইরে যে চর্বি লেগে থাকে সেটা রান্নার আগে কেটে ফেলে দিলে কোলেস্টেরলের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা যায়।
♦ চেষ্টা করুন মাংসগুলো ছোট ছোট টুকরা করে কাটার। কেননা মাংসের টুকরা যত ছোট হবে ততই এর চর্বির পরিমাণ কমে যাবে। এ কারণে গরুর মাংস কিমা অথবা মাংস বাটায় চর্বি সবচেয়ে কম থাকে।
♦ মাংস কাটা শেষে সেটা ভালোভাবে ধুয়ে কিছুক্ষণ পানিতে সিদ্ধ করলে দেখা যাবে চর্বির স্তর উঠে আসছে।
♦ দৈনিক ৮৫ গ্রামের বেশি খাবেন না।
♦ বেশি তেল দিয়ে ভুনা করার চেয়ে বারবিকিউ, গ্রিল, কাবাব খেলে ক্ষতি এড়াতে সহায়তা হবে।
♦ মাংসে থাকা চর্বি আরো কমাতে ভিনেগার, লেবুর রস বা টক দই দিয়ে রান্না করতে পারেন।
♦ বেশি তেল, বেশি মসলা দিয়ে ভুনা মাংস রান্না করার চেয়ে ভালো হয় ঝোল ঝোল করে রান্না করলে এবং খাওয়ার সময় সেই ঝোল এড়িয়ে গেলে।
♦ মাংসের সঙ্গে বিভিন্ন সবজি, যেমন—মিষ্টি কুমড়া, লাউ, পেঁপে ইত্যাদি মেশালে মাংস কম খাওয়া হয়।
♦ মাংস ফ্রিজে বা কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা পরিবেশে রাখলে এর ওপর তেলের একটি আস্তর পড়ে। সেটা ফেলে দিয়েও ফ্যাট অনেকটা কমানো সম্ভব।
অতিরিক্ত খাওয়ার ঝুঁকি
♦ গরুর মাংসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। এ থেকে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
♦ গরুর মাংসে যে কোলেস্টেরল থাকে সেটি বেশি বেড়ে গেলে হার্টের শিরায় জমে রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দেয়। এতে হার্টে পর্যাপ্ত রক্ত চলাচল করতে পারে না, অক্সিজেনের অভাব হয়। ফলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।
♦ গবেষণা বলছে, গরুর মাংস বেশি খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেশি থাকে।
এ ছাড়া গরুর মাংস বেশি খেলে টাইপ-টু ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া, আর্থ্রাইটিস, কোষ্ঠকাঠিন্য, ত্বকের সমস্যা ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।