ভোর থেকে লকডাউন শুরু, কঠোরতার হুশিয়ারি

Share on Facebook

করোনাভাইরাস মহামারীতে রেকর্ড আক্রান্তের পরদিন সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে সাত দিনের কঠোর লকডাউনে যাচ্ছে দেশ। এই সময়কালে মানুষকে ঘরে রাখাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কঠোর হওয়ার ‘হুশিয়ারি’ দিয়েছে সরকার।

সর্বাত্মক এই লকডাউন নিশ্চিত করতে সেনা মোতায়েন থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, আইন শৃংখলা বাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারির কথা সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায় থেকে বলা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া এই লকডাউন চলবে ৭ জুলাই পর্যন্ত। এসময়ে জরুরি কারণ ছাড়া ঘরের বাইরে বের হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে বারবার।

এমন কঠোর হওয়ার প্রেক্ষাপটও তৈরি হয়ে আছে গত কয়েকদিন ধরে। বুধবার দেশে গত এক দিনে আরও ৮ হাজার ৮২২ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।


আক্রান্তদের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় আরও ১১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এ ভাইরাসে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এ নিয়ে টানা চতুর্থ দিন একশর বেশি মৃত্যু দেখতে হল বাংলাদেশকে। সব মিলিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১৪ হাজার ৫০৩ জন হয়েছে।

এপ্রিলের রেকর্ড ভেঙে ৮ হাজার ৩৬৪ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল গত সোমবার। সেই রেকর্ড দুই দিনও থাকল না।

নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত মোট ৯ লাখ ১৩ হাজার ২৫৮ জনের আক্রান্ত হওয়ার তথ্য এসেছে সরকারের খাতায়। আগের দিন মঙ্গলবার এই সংখ্যা নয় লাখের ঘর অতিক্রম করে।

সংক্রমণের এমন পরিস্থিতিতেও কঠোর লকডাউনের আগে যেভাবে মানুষ ঢাকা ছেড়েছে তা বলার মত নয়। গত মধ্য মার্চে দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর এপ্রিলে বিধিনিষেধের ঘোষণা আসার পরও এমনটি ঘটেছিল।

চলমান সীমিত লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও গত কয়েকদিনে যে যেভাবে পেরেছেন মরিয়া হয়ে রাজধানী ছেড়েছেন।

বুধবারও গাদাগাদি করে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ফেরিতে, ট্রাকে করে সবাই গ্রামের বাড়ি যেতে ছিলেন বেপরোয়া।

এরপরও বৃহস্পতিবার ভোর থেকে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনে সংক্রমণ কমবে বলে এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন এক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। ভালো ফল পেতে বিধিনিষেধের সময় বাড়িয়ে দুই সপ্তাহ করার পরামর্শও দিয়েছেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন।

তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় আমরা দেখেছি চলাচলের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর দুই সপ্তাহের মধ্যেই সংক্রমণ কমে গেছে।

“তিন সপ্তাহের মাথায় মৃত্যুর সংখ্যা কমে গেছে। এবারও আশা করছি এমন হবে। এটা খুব দরকারি পদক্ষেপ ছিল।”

বৃহস্পতিবার থেকে প্রাথমিকভাবে এক সপ্তাহের লকডাউন জারি করা হলেও প্রয়োজনে সময় বাড়ানো হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।

ডা. মুশতাক আরও বলেন, “এবারের লকডাউন বাস্তবায়নে ক্ষেত্রে একটা নতুন চ্যালেঞ্জ যোগ হয়েছে গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া।“

এজন্য গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।

প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ শহরকেন্দ্রিক ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এবারের ঢেউ গ্রামে ছড়িয়েছে। বিশেষ করে খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।

“গ্রামাঞ্চলের জনস্বাস্থ্যের যেসব কাঠামো আছে সেগুলো সক্রিয় হলে এবং গ্রামের মানুষ নিজেরা সংক্রিয় হলে সংক্রমণ কমিয়ে আনতে পারবে।”

দেশব্যাপী কড়াকড়ির এই লকডাউন প্রতিপালনের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে:

>> সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।

>> সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব যন্ত্রচালিত যানবাহন, শপিংমল, মার্কেটসহ সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে।

>> বন্ধ থাকবে সব পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র।

>> জনসমাবেশ হয় এমন সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান-ওয়ালিমা, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি), রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

>> আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জরুরি পরিষেবার যানবাহন চলাচল করতে পারবে।

>> জরুরি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন দেখিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।

>> বরাবরের মত পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত যানবাহন নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।

>> আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চললেও বন্ধ থাকবে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট।

>> বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকেট দেখিয়ে গাড়ি ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারবেন।

>> এ সময় বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল বন্দর এবং সংশ্লিষ্ট অফিস নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।

>> শিল্প-কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে।

>> কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনা-বেচা করা যাবে।

>> খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রি (অনলাইন/টেকওয়ে) করতে পারবে।

>> অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনা, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না।

>> নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

> যারা করোনাভাইরাসের টিকার তারিখ পেয়েছেন, টিকা কার্ড দেখিয়ে তারা কেন্দ্রে যাতায়াত করতে পারবেন।

এদিকে কঠোর লকডাউনের মধ্যে দেশের সব আদালত ৭ জুলাই পর্যন্ত বন্ধ থাকছে। বুধবার সরকার লকডাউনের বিধি-নিষেধ আরোপের পর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আদালত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানায়।

ব্যাংকিং সেবা চালু রাখতে কঠোর লকডাউনের মধ্যেও সপ্তাহে খোলা থাকবে সপ্তাহে চার দিন; প্রতিদিন সাড়ে ৩ ঘণ্টা চলবে লেনদেন। বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকও ব্যাংকগুলোর লেনদেনের নতুন সময়সূচি প্রকাশ করে নির্দেশনা দেয়।

প্রথমবার লকডাউনে মসজিদ, মন্দিরসহ উপাসনালয়গুলো বন্ধ রাখা হলেও এবারের লকডাউনে তা খোলা রাখার নির্দেশনা এসেছে।

তবে এ সময় কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধর্মীয প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। মার্চের শেষ সপ্তাহে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।

তবে এর আগে ১৭ মার্চ থেকেই দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২৬ মার্চ থেকে সব অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

জীবন ও জীবিকার এই অসম সমীকরণ মেলাতে গিয়ে অন্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও মে মাসের শেষ দিকে বিধিনিষেধ শিথিল করা শুরু হয়।

টানা ৬৬ দিনের লকডাউন ওঠার পর ৩১ মে থেকে অফিস খোলার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচালের অনুমতি দেয় সরকার। ধীরে ধীরে শুরু হয় ফ্লাইট চলাচল। অগাস্টে বিনোদন কেন্দ্রও খুলে দেওয়া শুরু হয়।

এ বছরের শুরুতে সংক্রমণের হার কমে যাওয়ায় বিধি-নিষেধও শিথিলতা আসে। ২০২১ সালের শুরুতে সংক্রমণের নিম্নগতিতে বিধি-নিষেধ ছিল না বললেও চলে।

সরকার এই সময় স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া পরিকল্পনাও করেছিল।

তবে গত মার্চ মাসের শেষে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ পরিস্থিতি নাজুক করে তুললে ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত এসব নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার।

এ সময় ১৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয় সেগুলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি হয়েছিল।

জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় গণপরিবহন, শপিংমল এবং বিপনিবিতান।

তবে এপ্রিলের লকডাউনে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও আদালত এবং বেসরকারি অফিস শুধু জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য সীমিত পরিসরে খোলা রাখা হয়।

তবে শিল্প কারখানা ও নির্মাণ কাজ চালু থাকে।

পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতিতে সেই বিধি-নিষেধ পর্যায়ক্রমে শিথিল করা হয়। গণপরিবহনসহ দূরপাল্লার বাস চলাচল শুরু হয়।

কিন্তু ভারতে পাওয়া কোভিডের ডেল্টা ধরনের সংক্রমণে জুনের মাঝামাঝিতে সীমান্ত জেলাগুলোতে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে পড়ে। পরে সেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এতে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপের পথে যেতে শুরু করে সরকার।

Leave a Reply