অপ্রিয় আলাপ : পর্যটনের বিভ্রান্তি, বিভ্রান্তির পর্যটন
Tweet
বাংলায় ‘শিল্প’ শব্দটার মানে ও ব্যবহার খুব বিভ্রান্তিকর, ইংরেজিতে আর্ট আর ইন্ডাস্ট্রির পার্থক্যটা সহজে বোঝা যায়, বাংলার ক্ষেত্রে তেমন নয়। আমাদের দেশে বিকাশমান আয়মূলক কোনো খাতের উন্নয়নে দায়িত্বশীলদের নানাবিধ কর্মকাণ্ড বিশ্লেষন করলে এই বিভ্রান্তি আরও পোক্ত হয়। পর্যটন খাতের ক্ষেত্রেও এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য। পর্যটন শব্দটির সাথে শিল্প যুক্ত হওয়ার পর এই খাতের উন্নয়নে চলমান কর্মপ্রবাহের ধারা ও গতি পর্যালোচনা করলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগবে- পর্যটনের পর শিল্প শব্দটির অর্থ আর্ট না ইন্ডাস্ট্রি, ‘শিল্প’ শব্দটির লক্ষ্য কি পর্যটনকে শিল্পকলায় রূপ দেওয়া না বাণিজ্যিক কর্মকান্ড করে তোলা।
বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় সকল কর্মকাণ্ডের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও এদেশে শিল্প তথা আর্টের সাথে অর্থের যোগাযোগটা জরুরী নয়, তাই আর্টিস্টের বাংলা শিল্পী আর শিল্পীদের দুঃস্থ হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের বাংলা ‘শিল্পপতি’, অর্থ-বিত্তের প্রাচুর্য না থাকা যাদের ক্ষেত্রে অপরাধ। পর্যটনকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হলেও পর্যটনকে ইন্ডাস্ট্রি করে তোলার পরিবর্তে আর্ট করে তোলার ক্ষেত্রেই যেনো অধিক মনোযোগ, পর্যটন আজও এক মনোযোগ বঞ্চিত দুঃস্থ আর্টিস্ট।
পর্যটন শব্দটির সাথে ‘শিল্প’ যুক্ত বিষয়ক আলোচনাতেও বিভ্রান্তি বিদ্যমান, কারণ দেশে পর্যটনকে আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে বা হয়নি এ বিতর্ক চলমান রয়েছে। বিতর্কের পক্ষ এবং বিপক্ষ অর্থাৎ উভয় পক্ষের কাছেই তথ্য প্রমাণ আছে। ‘জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ১৯৯২ এবং ২০১০’এ বারবার ‘পর্যটন শিল্প’ শব্দযুগল উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম সারির জাতীয় গণমাধ্যমে ‘পর্যটনক খাত’এর পরিবর্তে পর্যটন শিল্প ব্যবহার করা হয়েছে, পর্যটন খাতের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এবং সংশ্লিষ্টদের অধিকাংশই লেখায় ও বক্তব্যে পর্যটনকে ‘শিল্প’ হিসেবে চিহ্নিত করেন, কিন্তু সমস্যা হয় যখন বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের শিল্প হিসেবে পর্যটন খাতটি অনুপস্থিত থাকে।
সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পর্যটন কর্পোরেশন গঠন করেছিলেন, সে ১৯৭২ সালের কথা। ১৯৭৩সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আদেশ জারি করা হয়। যে রাতারগুলকে আমরা সম্প্রতি চিনেছি, ওই সময়ই বিভিন্ন বনের সাথে রাতারগুল সংরক্ষণের উদ্যোগসহ পর্যটন সহায়ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহন করা হয়।
আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে, অর্থাৎ সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে ‘বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করিয়া বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো’ (৪.১) অন্যতম প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করে ও ‘পর্যটনকে একটি অগ্রাধিকার প্রাপ্ত শিল্প হিসেবে গ্রহণ করা হইবে, এবং ইহা যথাযথভাবে বার্ষিক/পাঁচসালা পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হইবে.. ‘ (৫.২) পরিকল্পনা নির্ধারণ করে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ১৯৯২ প্রণয়ন করা হয়। এই নীতিমালায় উল্লেখ করা হয় ‘বেসরকারী খাতকে পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহী করিবার জন্য ইতিমধ্যেই হোটেল ও পর্যটন সংক্রান্ত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে শিল্প খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হইয়াছে।’ (২৩.৪) এছাড়া দেশের ধর্মীয় ও পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ পর্যটন গন্তব্যগুলোতে ‘স্বল্প ভাড়ার আবাসিক ব্যবস্থাদি গড়িয়া তুলিবার লক্ষ্যে এই শিল্পের জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রেয়াতী হারে ব্যাংক ঋণ মঞ্জুরীর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’ (৫.৩.১) তবে এই নীতিমালার লক্ষ্য কতটা অর্জিত হয়েছিল সে প্রশ্ন জাগায় দেড় যুগ পর প্রণীত ‘জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ২০১০’এর সরল স্বীকারোক্তি ‘বাংলাদেশে পর্যটন এখনো প্রারম্ভিক (Traking off) পর্যায়ে রয়েছে।’ এবং ‘আভ্যন্তরীন পর্যটনের বিকাশ হলেও বৈদেশিক পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়নি।’ (১.৩)
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে ‘জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ২০১০’ (এ নীতিমালা নিয়ে অপ্রিয় আলাপের তৃতীয় পর্বে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে আছে) প্রণয়ন, পর্যটন সহায়ক বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, বিমান, রেল ও সড়ক পরিবহন সেবার উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ট্যুরিজম বোর্ড গঠনের মত গুরুত্বপূর্ণ সব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
নিঃসন্দেহে এসব অতি প্রয়োজনীয় এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নে দায়িত্বশীলদের সদিচ্ছারও অভাব নেই। কিন্তু পর্যালোচনার বিষয় হলো- স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছরে পর্যটন খাতে আমাদের অর্জন কি, জিডিপি’তে সুনির্দিষ্টভাবে পর্যটন খাতের অবদান কত শতাংশ, পর্যটন খাত হতে বার্ষিক বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ কত এবং লক্ষ্যমাত্রা কত, নীতিমালায় শিল্প হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বিধায় এ প্রশ্নও সঙ্গত যে শিল্পখাত হিসেবে কতটুকু সুবিধা পর্যটন পেয়েছে। একথা সত্য যে, পর্যটন খাতের উন্নয়নে গৃহীত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া, প্রশ্ন হলো পরিকল্পনার কতভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং বাস্তবায়নের গতি কি সন্তোষজনক। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা হলো- পর্যটন এবং পর্যটন খাতের ‘উন্নয়ন’ এর নির্ধারিত সংজ্ঞা কি।
এসব প্রশ্নের মুখে প্রশ্ন আসতেই পারে যে, পর্যটনকে এতটা গুরুত্ব দিতে হবে কেনো। প্রশ্ন কঠিন হলেও উত্তর সহজ, জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ২০১০-এ ‘বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এদেশে পর্যটন ও সেবা শিল্প কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি’ স্বীকার বলা হয়েছে ‘… বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত হয়ে এদেশে পর্যটন ও সেবা খাতটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।’ (পর্যটন মন্ত্রণালয় ওয়েবসাইট হতে ডাউনলোড করা নীতিমালায় যদিও ‘পুরুত্বপূর্ণ অবদান’ লেখা রয়েছে)(১.৩)
উত্থাপিত প্রশ্নগুলো কঠিন নয়, উত্তরগুলো সহজ হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ অস্বস্তিকর। কোনো কোনো অস্বস্তিকর বিষয় নিয়ে আলাপ চলমান রাখা জরুরী, কারণ তাতে তর্কে বিতর্কে ভুল ভাঙে, অজানা বিষয় জানা হয়, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে পর্যালোচনার ফলে আলাপ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু অস্বস্তিকর আলাপ শুরুর কাজটা বেশ বিব্রতকর। বিব্রতবোধ করলেও ধারাবাহিক ‘অপ্রিয় আলাপে’ অস্বস্তিকর বিষয়ে আলোচনা চলমান রাখার চেষ্টা থাকবে।
সাঈদ আহমেদ, লেখক ও পর্যটক