হাওর যাপনে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম

Share on Facebook

হাওর এলাকার একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হচ্ছে, ‘বর্ষায় নাও আর শুকনায় পাও’। অর্থাৎ বর্ষাকালে নৌকায় আর শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে চলো। বর্তমানের পরিবর্তিত অবস্থায় প্রাচীন ও জনপ্রিয় প্রবাদটি তার অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

কিশোরগঞ্জের হাওড় সমৃদ্ধ তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে এখন ‘বর্ষায় পাও আর শুকনায় নাও’ দিয়ে চলতেও সমস্যা নেই। সারা বছর সড়ক পথে চলাচলের জন্য ৪৭ কিলোমিটার উঁচু পাকা সড়ক এবং ৩৫ কিলোমিটার সাব-মার্সিবল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এই সড়ক পথে ২২টি পাকা সেতু, ১০৪টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে এবং এই হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন নদীতে ৫টি ফেরি চালু করা হয়েছে। ফলে ‘ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক’ জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। সড়ক পথে ভ্রমণ করে শীত বা গ্রীষ্ম যে কোন সময়ই হাওড়ের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

অপরূপ ‘ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক’ আর নান্দনিক সৌন্দর্য্যের আধার হাওরের ডাকে আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৯ ব্যাচের প্রায় ২৮ জন বন্ধুবান্ধব (অনেকেই পরিবারসহ) গত ৮ অক্টোবর ২০২১ তারিখ শুক্রবার, সকাল ৬ টায় দুটি আধুনিক বড় মাইক্রোবাস আর দুটি ফেরারী জীপ যোগে ঢাকা-টংগী-জয়দেবপুর পথে রওয়ানা দেই কিশোরগঞ্জের পথে। মেঘনা পেট্রোলিয়ামের এমডি আমাদের বন্ধু সাইফুল্লাহ খালেদ রনির সৌজন্যে একটি ফিলিং স্টেশনে সামিয়ানা টাংগিয়ে গরম গরম মজাদার নাস্তা এবং অপর একটি ফিলিং স্টেশনে ডাবের পানি ও স্থানীয় ভাবে নির্মিত সুস্বাদু দইয়ের ব্যবস্থা যাত্রাটিকে আনন্দময় করেছিল।

এভাবেই খেতে খেতে, যেতে যেতে এবং রাস্তার পাশের হাওর অঞ্চলের অপরুপ শোভা দেখতে দেখতে দুপুর প্রায় ১২ টায় পৌছালাম কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়া ঘাটে। সেখান থেকে একটি ছোট্ট লঞ্চ/ট্রলার‍ যোগে প্রায় ১ ঘণ্টাব্যাপী যাত্রায় হাওরের স্বচ্ছ নীল জলরাশি পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম মিঠামইন উপজেলায়।

মিঠামাইন উপজেলার নবনির্মিত সরকারী ডাক বাংলোয় হাতমুখ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে হাওরের বোয়াল, আইড়, কেচকী মাছের সাথে দেশী মুরগীর সুস্বাদু সালুন সহযোগে দুপুরের খাবার সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম নবনির্মিত সড়ক (অল ওয়েদার) পরিদর্শনে। ৬/৭ টি ইজিবাইকে চেপে মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কের প্রায় ৭/৮ কিমি রাস্তা পেরিয়ে ভাতশালা ব্রীজের উপর থামলাম। সুর্যাস্তের ছবি অনেক দেখেছি, কিন্তু হাওরের সুর্যাস্তের ছবি প্রথম দেখলাম। হাওরের পানিতে বালিহাঁস জাতীয় অজস্র পরিযায়ী পাখি নির্ভয়ে দলবদ্ধভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে থাকায় অনেকের দৃষ্টিসীমায় পাখিগুলো ধরা পড়েনি।

ভাতশালা ব্রীজে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে গেল। ছবি তুলে এবং বিদায়ী সূর্যের নরম আলো গায়ে মেখে কেটে গেলো অনেকটা সময়। রোদ্র আরো কোমল হয়ে আসছে, এবার ফেরার তাড়া। ইজি বাইকে করেই দুই পাশের সংক্রামক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হতে হতে ফিরে এলাম মিঠামইন উপজেলায়। পরবর্তী গন্তব্য মহামাণ্য রাষ্ট্রপতির বাসভবন।

বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবেই অতিথি পরায়ণ৷ যার ঘরে খাবারের বাহার নেই, সেও পানি চাইলে সাথে মুড়ি কি চিড়া পরিবেশন করে৷ কিশোরগঞ্জের মানুষের অতিথি সেবার সুনাম সারা দেশে রয়েছে। রাষ্ট্রপতির বাসভবনে এই আয়োজন আরও বিশাল ও বিস্তৃত, অতিথি আপ্যায়নের মেনুতে প্রচুর খাবারের ব্যবস্থ ছিলো। কিন্তু সময় সন্ধ্যা ঘণিয়ে রাতের দিকে যাত্রা করায় আর ফেরার তাড়ায় মুখরোচক কত খাবার খেতে যে বাকী রয়ে গেল। তবে বন্ধু রনি এবং ভাবীর সৌজন্যে অষ্টগ্রামের বিখ্যাত পনির পরিবার প্রতি ১ প্যাকেট করে উপহার পাওয়ায় আনন্দিত হয়েছিলাম সবাই।

মানুষ মাত্রই ঘরে ফেরার দায়বদ্ধতা, আমাদেরও ফিরতে হবে। আধ ঘণ্টা আগেই শেষ বিকেলের সূর্য্য ময়াময় আলো ছড়িয়ে বিদায় নিয়েছে। একই ছোট লঞ্চ বা ট্রলারে আমাদের ফেরার যাত্রা শুরু। একাদশীর চাঁদ আকাশে কিছুক্ষণ দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেছে, চারদিকে নেমেছে গাঢ় আধার।

আমাদের লঞ্চের সারেং এর নাম লাদেন, বয়স বড় জোর ১৮ থেকে ২০। লঞ্চ চালনায় দক্ষ বলে মনে হলো না, যাত্রা শুরুর ১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই একটি বড় নৌকার সাথেই ২/৩ বার বেশ জোরেশোরেই সংঘর্ষ হয়ে গেলো। হাওরের বুকে পালকের মত লঞ্চ দুলে উঠলো। আমাদের মধ্যে মিলটন সহ অনেকেই সাঁতার জানে না, গাঢ় অন্ধকার থাকায় প্রবল দুলনিতে তাদের চেহারার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা সম্ভব হলোনা।অন্ধকারের কারণেই অবিভ্যক্তির মুহুর্তটিকে ফ্রেমে ধরে রাখাও গেলো না। আমি মোটামুটি সাঁতার জানলেও বেশ ভয় ভয় লাগছিল, এই কূলহীন হাওরের স্রোতের নাচনে সাতার কতটুকু কাজে দিবে ওই সংশয় রয়েই যায়।

জোৎস্না রাত্রির অপরুপ সৌন্দর্য্য বহুবার দেখা হয়েছে। চন্দ্রগ্রস্থ ক্ষণের ছবির মত বর্ণনা হুমায়ুন আহমেদ এবং শরৎ চন্দ্রের উপন্যাসে পড়েছি। কিন্তু চন্দ্রহীন অন্ধকার রাতেরও যে অপার সৌন্দর্য আছে তা এবার প্রথম অনুভব করলাম। আকাশে একটি একটি করে তারা জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তারার মেলায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জলতর হয়ে উঠলো আকাশ। তারার স্নিগ্ধ আলোর প্রতিফলনে সম্পূর্ণ হাওর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে আবাছায়াময় মৃদু আলোর মসৃণতা। সৃষ্টিকর্তার সে কি অপরুপ সৃষ্টি! না দেখলে বোঝানো অসম্ভব, ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য!

প্রায় ১ ঘন্টা ২০ মিনিটের ভয়ংকর সুন্দর একটি নৌভ্রমন শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখোলা ঘাট। আমাদের গাড়িগুলো আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। এবার ঢাকায় ফেরার পালা, যাত্রাপথে কিছুটা পরিবর্তন করে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব-ঢাকা পথে যাত্রা শুরু। ভৈরবের একটি চমৎকার সুসজ্জিত রেস্টুরেন্টে সংক্ষিপ্ত ডিনার (সম্ভবত ইংরাজীতে একে বলে সাপার) শেষে প্রায় রাত ১২ টায় ঢাকায় পৌছলাম।

আমার মনে হয়, আমাদের গ্রুপের সকলেই অনেক অনেকদিন এই মনোরম ভ্রমনের কথা মনে রাখবে। এই অনিন্দ্যসুন্দর ভ্রমনের উদ্দ্যোগী এবং অংশগ্রহণকারী সকল প্রিয় বন্ধু, বান্ধবী এবং ভাবীদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন।

 

জিয়া খান লিটন
২২ অক্টোবর, ২০২১.

Leave a Reply