মা ও মেয়ের পৃথিবী দর্শন উপপাদ্য

Share on Facebook

 

মা আর মেয়ে পাশাপাশি হাঁটছে। সদ্য হাঁটতে শেখা মেয়ে মায়ের সাথে সমান তালে চলতে একটু হাঁটছে ক্ষণে ক্ষণে একটু দৌড়াচ্ছেও। মেয়ের হাঁটতে পারার উচ্ছলতা দেখে আনন্দে মায়ের বুক ভেঙে কান্না আসছে।

মেয়ে এখনো জানে না সন্তান জন্মদানের পর মায়েদের শতশত আবেগ-উচ্ছ্বাস মাটিচাপা দেওয়ার ত্রিকোণমিতি। মেয়ে এখনো জানে না সন্তানের নিরাপত্তা চিন্তায় কাটিয়ে দেওয়া মায়েদের বিনিদ্র রজনী কতটা দীর্ঘ। কান্না লুকানো মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়ে জিজ্ঞেস করছে মা আমরা এতো দ্রুত গতিতে হাঁটছি কেন? ধরে আসা গলায় দয়ার্দ্র কণ্ঠে মা জানতে চাইলো, মামুনি দ্রুত গতিতে হাঁটতে তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে! মেয়ে বলছে আমার একদম কষ্ট হচ্ছে না মা। তুমি আমার জন্য কোনো চিন্তা করো না। এই যে দেখো আমি তোমার চেয়েও দ্রুত হাঁটতে পারি। খিলখিল করে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে যাওয়া টগবগে সুন্দর ও নিস্পাপ মেয়ের দিকে তাকাতেই মায়ের মনে পরলো তার মায়ের কথা। মায়ের স্মৃতি মনে পরতেই একফোঁটা নোনা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো মাটিতে। সবুজ ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুর সাথে মিশে যাওয়ার আগে শিশির অথবা মেয়ে কেউই জানলো না এই একফোঁটা নোনা জলের কষ্ট কতোটা আদিম-অকৃত্রিম ও অসহনীয়।

কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তের দিকে তাকিয়ে মায়ের মনে পড়ছে সেও যখন প্রথম হাঁটতে শেখে সেও যখন প্রথম এই একই প্রশ্ন তার মায়ের কাছে করেছিলো, মা তাকে বলেছিলো- মা রে গতিই জীবন। এরপরের দৃশ্যটুকু স্মরণ করার মতো পোক্ত অবস্থায় এই ছোট্ট হৃদয় এখনো পৌঁছাতে পারে নাই। স্পষ্ট করে শুধু এতোটুকুই হয়তো বলা যেতে পারে, এই গতিময়তার ছন্দপতন হয়েছিল তার চোখের সামনেই। মা একবার মনেমনে ভাবছে আজ সেই ছন্দ পতনের গল্প মেয়ের কাছে বলে নিজেকে একটু হালকা করে নিবে কি-না। আবার ভাবছে থাক কী দরকার। নিজেকে হালকা করার জন্য এতোটুকুন একটা বাচ্চা মেয়ের মনে বিষাদের ছাপ এঁকে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তারচেয়ে মেয়েটা যতদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকে একটু আনন্দ-ফুর্তি করেই বাচুঁক।

মা-মেয়ে গল্প করতে করতে একটা ছোট্ট নদীর সামনে এসেছে পৌঁছে গেল। মা মেয়েকে বলছে মামুনি আমরা এখন নদীটা পার হবো। ঐ পাড়ের সুন্দর পরিবেশে আমরা বসবাস করবো। তুমি সারাদিন ছোটাছুটি আর খেলাধুলা করবে পৃথিবী তোমার জন্য মঙ্গলময় হবে। একথা শুনেই বাচ্চা মেয়েটা মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আনন্দে লাফালাফি করছে আর বলছে কী মজা কী মজা। আমি সারাদিন খেলাধুলা করবো। নদীটি স্রোতস্বিনী নয় তবে হালকা একটু স্রোত আছে। যতটুকু স্রোত আছে তাতে মা আর মেয়ে অনায়াসেই পার হতে পারবে অসুবিধা নাই। তবুও তো মায়ের মন। স্রোতের বিপরীতে সাতার দিতে মেয়ের না জানি কষ্ট একটু বেশি হয়ে যায়! মেয়েকে একবার কাছে ডেকে নিয়ে মা বলছে দেখতো মামুনি তুমি এই স্রোত পাড়ি দিতে পারবে কি-না! আমি পারবো, কোনো অসুবিধা হবে না বলে মাকে আস্বস্ত করতে চাইলো মেয়ে। তবুও মা বলছে তুমি কি একবার একটু সাতাঁর কেটে আমাকে দেখাবে? অবশ্যই বলে মেয়ে লাফিয়ে পানিতে নেমে কিছুদূর সাতাঁর কেটে মায়ের কাছে ফিরে এসে অভিমানী সুরে বলছে, দেখছো আম্মু আমি কেমন পারি। অথচ তুমি আমার উপরে ভরসা রাখতে পারছো না!

কৃত্রিম অভিমানে ফুলে ওঠা মেয়ের গালে আলতো করে চুমু দিতে গিয়ে মা আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। ঘটনার ধ্রুপদী আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে কান্না বিগলিত গলায় মেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করছে তুমি কান্না করছো কেন? মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আশ্বস্ত করে মা বলছে মামুনি এটাকে কান্না বলে না। এটা হচ্ছে আনন্দাশ্রু। মেয়ের সাতাঁর কাটার সফলতায় মায়ের আনন্দ অশ্রু। তারপর মেয়েকে সামনে টেনে নিয়ে মুখোমুখি হয়ে মা বলছে লক্ষ্মী মেয়ে আমার, এখন আমি যা বলি তা খুব মনযোগ দিয়ে শুনবে। অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। একটু এদিক-ওদিক করবে না, ঠিক আছে?
জ্বি আম্মু বলো। আমি তোমার সবকথা শুনবো। আমি তো তোমার লক্ষ্মী মেয়ে।
ঐ পাড়ে যে কেওড়া গাছটা দেখছো নদী সাতঁরিয়ে সেখানে গিয়ে উঠবে। আমি গাছটার নিচে থেকে তোমাকে নিয়ে ডানে চলে যাবো। মেয়ের গালে আরেকটা চুমু দিয়ে বলছে তুমি আমার সামনে সাতঁরাবে আমি তোমার পিছনে থাকবো। যত বাধাই আসুক না কেন তুমি শুধুমাত্র সামনে এগিয়ে যাবে, ভুলেও কখনো পিছনে তাকাবে না। স্রোতের মধ্যে সাতরানোর সময় পিছনে তাকাতে নেই। পিছনে তাকালেই তুমি স্রোতে ভেসে যাবে। তখন আমাদের অনেক কষ্ট হবে। আমি তোমার পিছনে আছি তুমি শুধু সামনের দিকে তাকাবে। পিছন থেকে যতো বাধাই আসুক আমি তোমাকে রক্ষা করবো, ঠিক আছে মামুনি?

ওকে আম্মু বলে মেয়ে পানিতে নেমে অল্প অল্প স্রোত কাটিয়ে সফলভাবেই এগিয়ে চলছে। এই দৃশ্য দেখে খুশিতে মায়েরই নাচতে ইচ্ছে করছে। মেয়ে নদীর মাঝ বরাবর পৌঁছে গেছে আরেকটু এগিয়ে গেলেই নদীর কিনার। কিনারের পাশেই ক্যাওড়াতলা। ঠিক এই সময়ে একটা দৃশ্য দেখে মায়ের বুক ভেঙে কলিজা বের হয়ে আসার উপক্রম। চোখের কোটর ভেঙে যেন এখনি বেরিয়ে পরবে চোখ দু’টো। একচুল সময় নষ্ট না করে মা লাফিয়ে নামলো পানিতে। মেয়েকে রক্ষা করার জন্য চার হাত পায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে স্রোত ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়ের দিকে। মেয়ে প্রায় পৌঁছেই গেছে কিনারে। আরেকটু সময় পেলেই নিরাপদে উঠে যাবে নদী থেকে। সেই সময় টুকুই দেওয়ার জন্যই মা মাঝ নদীতে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে গেছে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটুকু বিসর্জন দেওয়ার বিনিময়ে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। মেয়ে কখন বাকি পথটুকু পারি দিয়ে উঠে যাবে ডাঙায়! শিকারের সন্ধানে পিছন দিক থেকে উর্ধশ্বাসে ছুটে আসা রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবার লক্ষ্য পরিবর্তন করে মেয়েকে ছেড়ে মায়ের ঘাড়ে বসিয়ে দেয় বিষ দাঁত। বাঘের থাবায় পানির নিচে ডুবিয়ে যেতে যেতে মা হরিণ দেখছে তার আদরের শাবক ক্যাওড়া তলায় পৌঁছে গেছে সফলভাবে। দেহের সমস্ত শক্তি খরচ করে মা হরিণ চিৎকার করে বলতে চাচ্ছে, পিছনে তাকাবে না মামুনি, সামনে এগিয়ে যাও পৃথিবী তোমার জন্য মঙ্গলময় হোক……

Leave a Reply