লাউ-কুমড়া সাজানোই তাঁর পেশা
Tweet
২০১০ সালের জুনে নিজের গায়েহলুদের সাজসজ্জায় নতুনত্ব আনতে ফল-সবজি কাটাকাটি (ফুড কার্ভিং) করেছিলেন। তাই দেখেই অতিথিরা উচ্ছ্বসিত। সেই শুরু। আবিদা সুলতানা বলেন, ‘বিয়ের আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল কখনো কর্মহীন থাকব না। আমার বিয়েরটা দেখে একজন তাঁর বিয়েতেও ফুড কার্ভিং করে দিতে বলেন। এভাবে অর্ডার পেতে থাকি। গায়েহলুদের অর্ডার পেলে বিয়েতে বর–বউ যে টেবিলে খাবে, তার ডেকোরেশনও ফ্রি করে দিতাম। এভাবে অর্ডার বাড়তে থাকে।’ কার্ভিং এখন আবিদা সুলতানার পেশা। ইম্পেরিয়াল হোটেল ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের তিনি একজন প্রশিক্ষকও।
আবিদা সুলতানার ফুড কার্ভিং দেখতে এক দুপুরে রাজধানীর চান মিয়া হাউজিংয়ে তাঁর বাসায় গিয়ে হাজির হই। নতুন অর্ডারের জন্য ফোন আসছে, নয়তো ডেলিভারি নিতে লোক আসছে, তার মধ্যেই দ্রুত হাতে কার্ভিং করছিলেন আবিদা। দেখতে দেখতে গাজর হয়ে গেল ফুল ও পাতা। টমেটো হয়ে গেল ফুল। মিষ্টি কুমড়াসহ অন্যান্য ফল-সবজি কোনোটা পাখি, কোনোটা আলপনার রূপ নিল। হাসতে হাসতে আবিদা সুলতানা বললেন, ‘এখন এটি নেশা হয়ে গেছে। চলার পথে মিষ্টি কুমড়া, লাউ দেখলে মনে হয় চাকু নিয়ে এখনই কাটাকাটি শুরু করি। ১২ বছর এই লাউ, কুমড়া নিয়ে লেগে থেকে এখন একটি পর্যায়ে আসতে পেরেছি। যা আয় করছি, তা দিয়ে সন্তানদের নানান বায়না, নিজের শখ বা সংসারের টুকিটাকি কাজে ব্যয় করছি। আমি একা নই, আমার মা–ও দিনাজপুরে ব্রাইডাল কালেকশন নামের গায়েহলুদের ডালাসহ বিভিন্ন পণ্যের একটি দোকান সামলাচ্ছেন। এক বোন রাজশাহী থেকেই অনলাইন ব্যবসার কাজে সহায়তা করছে, সেও কিছু আয় করছে। এর বাইরে দিনাজপুর ও ঢাকায় পাঁচজন কর্মীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।’
শুধু কার্ভিংই না, গায়েহলুদের গয়নাও তৈরি করেন আবিদা সুলতানা। হলুদের কুলা-ডালা দিয়ে সাজান স্টেজ। বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানের খাবার টেবিল সাজান। পিঠা বানিয়ে বিক্রি করেন। ব্রাইডাল ক্রিয়েশন নামের ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে অনলাইনে অন্যদের শেখান। স্বপ্নচূড়া মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সংস্থা নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে দুস্থ নারীসহ বিভিন্ন বয়সী ও পেশার নারীদের প্রশিক্ষণও দেন। আর এসবই একাই সামলান।
এ ধরনের একটি বিষয় নিয়ে ব্যবসা, পরিবারের সায় ছিল? উত্তরে আবিদা সুলতানা বলেন,‘ফল-সবজি কাটাকাটিকে পেশা হিসেবে নেব, আর শুরুতেই পরিবার তাতে সায় দেবে—এমনটা ভাবাই তো ভুল। ব্যবসার জন্য বিষয়টি প্রায় নতুনই বলা যায়। স্বজনদের অনেকেই নেতিবাচক কথা বলতেন। আবার অনেক আত্মীয় নিজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অর্ডার করতেন, অন্যরাও যাতে অর্ডার করে তার জন্যও চেষ্টা করতেন।’
একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করতেন আবিদা সুলতানা। দুই মেয়ে ও পরিবারকে সময় দিতে এক সময় চাকরিটা ছেড়ে দেন। নতুন করে আবার ব্যবসার কাজে জড়িয়ে পড়ে পরিবারকে যে কম সময় দেন, তা কিন্তু নয়। বাচ্চারা যখন ঘুমায় বা স্কুলে থাকে, তখন রাত জেগে বা অবসরে কাজগুলো যতটুকু সম্ভব গুছিয়ে রাখেন তিনি।
আবিদা সুলতানার সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর আশপাশে ফল ও সবজি গড়াগড়ি খাচ্ছিল। জানালেন, সেদিনের অর্ডারের জন্য কিছু লাগবে, আবার অন্য অর্ডারের জন্যও কিছু কাজে লাগবে। নতুন কিছু কিনতেও হবে। শীতের মৌসুমে অর্থাৎ নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ফুড কার্ভিং ও হলুদের ডালা থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা হাতে থাকে। তবে অন্য সময় ফুড কার্ভিং থেকে আয় কমে যায়। তখন পিঠা, মেহেদিসহ অন্যান্য ব্যবসা থেকে আয় করেন।
ফুড কার্ভিংয়ে অনেক যত্নের প্রয়োজন হয় জানিয়ে আবিদা সুলতানা বলেন, অনেকেই ভাবেন ৫০ টাকা দিয়ে একটি মিষ্টি কুমড়া কিনে তাতে কারুকাজ করে দাম এক হাজার টাকা কেন রাখতে হবে। এটাকে মিষ্টি কুমড়া হিসেবে দেখলে চলবে না। কারুকাজ করা মানে এটি একটি শিল্প। করতে মেধা ও শ্রম লাগে। ছোট ছোট ফুড কার্ভিংয়ের জন্য অনেক ক্রেতা যাতায়াত ভাড়া দিতে চান না। অথচ এই কার্ভিংগুলো খুব সহজেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে, তাই সিএনজি, উবারে যাতায়াত করতে হয়।
তবে শিল্পটি সম্পর্কে ধারণা আছে, এমন সমঝদার ক্রেতার সংখ্যাই বেশি বলে জানালেন আবিদা সুলতানা। ওই ক্রেতারা দরদামের চেয়ে সৌন্দর্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন বেশি। আবার অনেক ক্রেতা টাকা খরচ করতে চান, কিন্তু টাকাটা কীভাবে খরচ করবেন বুঝতে পারেন না; তাঁদের বোঝাতেও সময় লাগে। আবিদা সুলতানার ফুড কার্ভিংয়ের বিভিন্ন প্যাকেজ তিন হাজার থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। ডালা সাজানোর জন্য আছে ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকার প্যাকেজ।
ফুড কার্ভিংকে পেশা হিসেবে নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমই) অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করলেন আবিদা সুলতানা। ফাউন্ডেশন থেকেই প্রথম এ বিষয়ে একটি কোর্স করেছিলেন তিনি। ব্যবসাসংক্রান্ত সব তথ্যও এ ফাউন্ডেশন থেকে পান। ফাউন্ডেশন আয়োজিত মেলায় অংশ নেন নিয়মিত। এ ছাড়া ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সাতটি বিভাগে ‘ব্যবসা বহুমুখীকরণ উদ্বুদ্ধকরণ প্রোগ্রামে’ অংশ নেন আবিদা সুলতানা। নতুন উদ্যোক্তাদের শুধু বুটিক না, নতুন ব্যবসা নিয়ে কথা বলেন।
আবিদা সুলতানার স্বামী মো. ইরফান একটি বহুজাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। রাজধানীর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে ব্যবহারিক শিল্পকলায় মাস্টার্স করেছেন আবিদা। বললেন, ‘যখন কাজের চাপ বেশি থাকে, তখন মাঝেমধ্যে কাজটা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। তবে কাজ শেষে হাতে যখন পাওনা টাকা পাই, তখন পরিশ্রমের কথা ভুলে যাই। নতুন কাজ নিয়ে ভাবনা শুরু করি।’