সুন্দরবন ভ্রমণের খরচ বাড়ল, শঙ্কায় পর্যটন ব্যবসায়ীরা
Tweet
সুন্দরবনে ভ্রমণের প্রায় সবগুলো খাতে কর ও ফি বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনে বেড়াতে গেলে দৈনিক ভিত্তিতে ভ্রমণ ফি, প্রবেশ ফি, তথ্য কেন্দ্রের ফি, গাইড ফি, লঞ্চ ক্রু ফি, নিরাপত্তা গার্ড ফি, টেলিকমিউনিকেশন ফি, ভিডিও ক্যামেরা ফি, তীর্থ ফি, ট্রলার ফি এবং বিশ্রামাগার ভাড়াসহ বিভিন্ন খাতে সরকারকে টাকা দিতে হয়।
এর মধ্যে অনেকগুলো খাতেই ফির পরিমাণ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। তাতে বিদেশি পর্যটকদের খরচ বেড়েছে অনেক বেশি।
ভ্রমণ মৌসুমের শেষ সময়ে এসে বনবিভাগের এই সিদ্ধান্ত রোমাঞ্চ ও নিসর্গপ্রেমীদের সুন্দরবন বিমুখ করবে কি না, সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
রোববার পর্যন্ত সুন্দরবনের সাধারণ জায়গাগুলোতে মাথাপিছু দেশি পর্যটকের ভ্রমণ ফি ছিল প্রতিদিনের জন্য ৭০ টাকা, সেটা এখন বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা।
এসব জায়গায় বিদেশি পর্যটকের আগে খরচ হত প্রতি দিন ১০০০ টাকা, এখন তা বাড়িয়ে ২০০০ টাকা করা হয়েছে।
সুন্দরবনের ভেতরে কটকা, কচিখালী, নীলকমল, হিরণ পয়েন্ট, নোটাবেকী,পুষ্পকাঠী, মান্দারবাড়িয়া, হলদেবুনিয়ার মত সরকার ঘোষিত অভয়ারণ্যগুলোতে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের প্রতিদিন ভ্রমণ ফি দিতে হত যথাক্রমে ১৫০ ও ১৫০০ টাকা। এখন তা দ্বিগুণ বেড়ে যথাক্রমে ৩০০ ও ৩০০০ টাকা হয়েছে।
পর্যটন ব্যবসায়ীদের শঙ্কা, সরকার দেশীয় পর্যটনের বিকাশের কথা বললেও হঠাৎ করে এই রাজস্ব বাড়ানোর ফলে নতুন করে ক্ষতির মুখে পড়বে সুন্দরবনের পর্যটন শিল্প। এর ফলে সুন্দরবনের প্যাকেজ ভ্রমণের খরচ অনেক বেড়ে যাবে।
প্রতি যাত্রায় সুন্দরবনের পর্যটকবাহী লঞ্চকে বনে প্রবেশ এবং অবস্থানের জন্য নির্ধারিত হারে ফি দিতে হয়। ১০০ ফুটের বেশি দৈর্ঘ্যের নিবন্ধিত লঞ্চের বেলায় আগে প্রবেশ ফি ছিল এক হাজার টাকা। তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫০০ টাকা। ৫০ ফুট থেকে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের লঞ্জের ক্ষেত্রে তা ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০০ টাকা হয়েছে।
একইভাবে সুন্দরবনে নৌযানের অবস্থান ফিও বেড়ে আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। পর্যটক লঞ্চের সঙ্গে থাকা ছোট ট্রলার, স্পিড বোট, লঞ্চের ক্রুদেরও সুন্দরবনে প্রবেশ ও অবস্থান ফি বেড়েছে একই হারে। পর্যটক গাইড, নিরাপত্তারক্ষী ফিও বাড়ানো হয়েছে।
সুন্দরবনে অনেকদিন ধরে পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত আছেন পাগমার্ক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম বাচ্চু।
তিনি বলেন, “সুন্দরবনে সিংহভাগ পর্যটককেই কোনো না কোনো ট্যুর অপারেটরের সাহায্য নিয়ে প্যাকেজ ভ্রমণে যেতে হয়। এখন ফি ও রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে প্যাকেজ মূল্য বেড়ে যাবে।”
খরচ কী পরিমাণ বাড়বে তার একটি ধারণা পাওয়া যায় নজরুল ইসলাম বাচ্চুর ব্যাখ্যায়। তিনি জানান, সুন্দরবনে দুই রাত তিন দিনের একটি ভ্রমণের প্যাকেজ আগে যেখানে ১০ হাজার টাকা লাগত, এখন দেশি পর্যটকের ক্ষেত্রে তা দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বেড়ে যাবে। আর বিদেশি পর্যটকের অন্তত ছয় হাজার টাকা বাড়তি গুনতে হবে।
সুন্দরবনে পর্যটন বিকাশে প্রশিক্ষিত গাইড রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে এই পর্যটন ব্যবসায়ী বলেন, ”এসব দিকে খেয়াল না করে শুধু মূল্যবৃদ্ধি সুন্দরবনে পর্যটন শিল্পের অনেক ক্ষতি করবে।”
২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই লাখ ৫১ হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন। এই সংখ্যা তার আগের বছরের চেয়ে ৩০ হাজার বেশি।
এ খাত থেকে সরকারের বছরে দুই কোটি টাকা রাজস্ব আয় হলেও স্বচ্ছন্দে ভ্রমণের ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকদের নানা রকম অভিযোগ রয়েছে।
নজরুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, “আমাদের দেশ যেহেতু পর্যটনবান্ধব নয়, তাই আমাদের বিদেশি পর্যটক আনতে হয় কষ্ট করে। এই মূল্য বৃদ্ধি সুন্দরবনে বিদেশি পর্যটককে সুন্দরবন বিমুখ করবে।”
সুন্দরবনে ভ্রমণের সব খাতে বাড়তি রাজস্ব ’স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা না করেই’ নির্ধারণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
”হলি আর্টিজানে হামলার পর সুন্দরবনে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা একেবারেই কমে গিয়েছিল। পরে বাড়তে শুরু করলেও মহামারীর ধাক্কায় তা আবার শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এরই মধ্যে এখন আবার এই রাজস্ব বৃদ্ধি সুন্দরবনে পর্যটনের জন্য অশনি সংকেত…।”
করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে চলায় ২০২০ সালের ১৯ মার্চ থেকে সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল বনবিভাগ। নির্দেশনার সাত মাস পর অক্টোবরে তা তুলে নেওয়া হয়। পরের বছর এপ্রিলের গোড়াতে দেশের অন্যান্য পর্যটন স্থানের মতো সুন্দরবনেও পর্যটক প্রবেশে কিছুদিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেয় কর্তৃপক্ষ।
আর এ বছর জানুয়ারিতে সুন্দরবনে পর্যটকবাহী নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পরে এক দিনের মধ্যেই তা প্রত্যাহার করে নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ।
পাশের দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানের মত বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে জোর দিয়ে পাগমার্ক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী নজরুল বলেন, “ইনবাউন্ড ট্যুরিজমকে আমরা যদি সমৃদ্ধ করতে না পারি তাহলে দেশের পর্যটন উন্নয়ন সম্ভব নয়।”
নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সুন্দরবনে পর্যটনের মৌসুম এবং এই সময়ে সেখানে বেশি পর্যটক যান। আর এই ভ্রমণ মৌসুমে ’আলোচনা ছাড়াই’ রাজস্ব বাড়ানো নিয়ে অভিযোগ জানালেন ট্যুর অপারেটর অ্যাসেসিয়েশন অফ সুন্দরবনের (টোয়াস) সাধারণ সম্পাদক ও রূপান্তর ইকোট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল আজম ডেভিড।
তিনি বলেন, ”বনবিভাগ রাজস্ব বাড়াতেই পারে। কিন্তু স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ করে বৃদ্ধি করা দুঃখজনক।
“আমাদের না জানিয়েই হঠাৎ করা হল কাজটি। আমরা এটা জানতে পারলাম প্রজ্ঞাপন হওয়ার পরে।“
নাজমুল আজম ডেভিডের ভাষ্য, ”পর্যটনকে নিয়ে সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কাজ করলেও এ বিষয় যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করা হয় না বলে সঠিক সিদ্ধান্তটা হয় না।
“এমন সময় রাজস্ব বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এল যেটা মৌসুমে মাঝখানে। সামনের দিনগুলো বেশিরভাগ ট্যুরই ইতোমধ্যে বুক হয়ে গেছে। কিন্তু এই মাঝপথে এসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণেরও বেশি রাজস্ব বাড়ানো হল, এটা তাদের (পর্যটকদের) কীভাবে চার্জ করব?”
প্রজ্ঞাপনের নতুন রাজস্ব এখনই কার্যকর না করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের একটা দাবি হল রাজস্ব বাড়ানোর ব্যাপারটা যেন বিবেচনা করা হয় এবং সেটা যেন অবশ্যই আগামী জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়।”
তবে রাজস্ব বাড়ানোকে ’স্বাভাবিক’ হিসেবেই দেখছেন সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা আবু নাসের মো. মহসিন।
বনবিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, ”এ রাজস্ব বৃদ্ধি শুধু পর্যটকদের জন্যই করা হয়নি। রাজস্ব সংক্রান্ত যত কার্যক্রম আছে, যেমন মাওয়ালী (মৌয়াল), বাওয়ালী (গোলপাতা সংগ্রহকারী), জেলে যারা যারাই আছেন সবার ক্ষেত্রেই রাজস্ব বৃদ্ধি করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনটি জারি করেছে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কয়েক বছর পরপরই এ রাজস্ব বৃদ্ধি হয়।“
বিদেশি পর্যটকদের রাজস্ব বেশি বাড়ানো নিয়ে তিনি বলেন, ”দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের প্রবেশমূল্য ও অন্যান্য রাজস্ব এখনো অনেক কম। এতে পর্যটনে কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না।”
সুন্দরবনে পর্যটনের পাশাপাশি দুবলার চরে রাস মেলায় পুণ্যার্থী ও সুন্দরবনে সব ধরনের বনজীবীদের জন্যও নতুন রাজস্ব হার নির্ধারণ করে দিয়েছে বন বিভাগ।