রাজা মামার চা এর যতো কথা
Tweet
বিমানবন্দর থেকে কসাইবাজারের দিকে যেতেই প্রধান সড়কের পাশে টিনের তৈরি একটি ছোট্ট দোকান। ‘রাজা মামার চায়ের আড্ডা’ নাম সেটার। সেখানে থরে থরে সাজানো তামার তৈরি অ্যারাবিয়ান ডিজাইনের কেটলি। কাজুবাদাম, পুদিনা পাতা, তেঁতুল, মাল্টা, লেবু, মরিচসহ হরেক রকমের মসলা বিন্যস্ত বিভিন্ন পাত্রে। সেদিন বিকেল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি নামলেও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের গ্যারেজের পাশে এই চায়ের দোকানে জমেছিল আড্ডা। ‘বিশেষ চা’ পান করতে বৃষ্টির মধ্যেও ছুটে এসেছিলেন চা-প্রেমীরা- যেমন আসেন সপ্তাহের আরও সব দিন।
ছোটবেলা থেকেই মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়- এমন কোনো কাজ করতে চাইতেন রাজা। তিনি এখন সবার কাছে পরিচিত ‘রাজা মামা’ হিসেবে। একসময় মনে হয়, চায়ের দোকানও এর উপায় হতে পারে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব পাশের এলাকায় চায়ের দোকান দেন তিনি। তারপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
প্রথমে রাজা প্রতি কাপ চা বিক্রি করতেন পাঁচ টাকায়। বিক্রি করতেন মাল্টা চা, কালিজিরা চা, তেঁতুল চা আর নরমাল দুধ চা। পাশাপাশি আবুধাবিতে শেখা বিভিন্ন দেশের চায়ের রেসিপি দিয়েও কিছু স্পেশাল চা বানাতে থাকেন। এগুলোর মধ্যে বিশেষত, কাজুবাদামের চা ও ইন্ডিয়ান মাসালা টি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার কাজুবাদামের চায়ের মধ্যে রয়েছে কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, হরলিকস, ম্যাটকফি, ব্ল্যাক কফি, কিশমিশ, চিনি, গুঁড়া দুধ ও কনডেনসড মিল্ক্ক। ইন্ডিয়ান মাসালা টি-তে রয়েছে তেজপাতা, এলাচি, লবঙ্গ, হরলিকস, গুঁড়া দুধ, কনডেনসড মিল্ক্ক ও ম্যাটকফি। আগে এ রকম এক কাপ চায়ের দাম নিতেন ১৫ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়।
সাম্প্রতিক সেই সন্ধ্যায় মিরপুর থেকে রাজার চায়ের আড্ডায় সপরিবারে এসেছিলেন শিহাবুর রহমান। পরপর দু’বার খেলেন পছন্দের রাজা মামার চা। কারণ, এক কাপ চায়ে তার মন ভরে না। শিহাব বলেন, ‘সাধারণ চায়ের কাপের চেয়েও বড় মাটির পাত্রে চা দেওয়া হয় এখানে। কাজুবাদামের গন্ধ, চায়ের ঘনত্ব- সব মিলিয়ে অন্য ধরনের চা খেতে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিজের গাড়ি নিয়ে চলে আসি এখানে। আজ এসেছি পরিবারের সবাইকে নিয়ে।’
দিনে হাজারের বেশি কাপ চা বিক্রি করেন রাজা। নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও গাজীপুর থেকেও ক্রেতা আসেন শুধু ‘রাজা মামার স্পেশাল চা’ পানের জন্য। বেশিরভাগ ক্রেতাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী। তাদের ভালোবাসায় এখন পরিপূর্ণ রাজা।
কথায় কথায় রাজা মামা জানান, ১৯৮১ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালের নওধার গ্রামে জন্ম নেন তিনি। তার বাবা আলীম উদ্দিন জানতেন না, কীভাবে রেহাই মিলবে অভাব থেকে। দুই ভাই ও চার বোনের সংসারে আলীমই ছিলেন একমাত্র রোজগেরে। সংসারের অভাব দূর করতে রাজা একসময় রাজধানীতে এক কর্নেলের বাসায় কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি পড়াশোনাও করতে থাকেন। তার বাবা আলীম উদ্দিন প্রতি মাসে এসে টাকা নিয়ে যেতেন।
রাজার বেশ ভালো লাগত যে বাবা কিছু টাকা পাচ্ছেন। তবে তার আনাগোনায় বিরক্ত হন কর্নেলের স্ত্রী। ফলে কাজ চলে যায় রাজার। ত্রিশালে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে একজনের দুটি গরু দেখাশোনার কাজ শুরু করেন তিনি। একসময় কাঠ কুড়িয়ে তা বিক্রির কাজও শুরু করেন। আয়ের টাকা তুলে দিতেন মায়ের হাতে। কাঠ কুড়াতে কুড়াতেই রাজা ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডে হকার হিসেবে পান, সিগারেট, জিঞ্জার, চকলেট ইত্যাদি বিক্রির কাজে নেমে পড়েন।
একসময় রাজা চলে আসেন ঢাকার বিমানবন্দরে। এখানে তিনি রাত কাটাতেন বিমানবন্দর এলাকার পাবলিক টয়লেটের ছাদে। পরে বেলায়েত সরকার নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় হলে তিনি তাকে বিদেশে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু বিদেশ যেতে যে অনেক টাকা লাগবে, রাজা তা পাবেন কোথায়! এরই মধ্যে বেলায়েত জানান, এখনই কোনো টাকা দিতে হবে না তাকে। বিদেশে চাকরি পেয়ে বেতন হলে তার থেকে টাকা কেটে নেবেন তিনি।
রাজা রাজি হন। অভাব থেকে মুক্তি মিলবে- এ আশায় বিদেশের পথে পাড়িও জমান রাজা। সেখানেও মন টেকে না।
বিদেশে যাওয়ার পর কাপড় ও বাসন ধোয়ার কাজ পান। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই হাতের আঙুলের ফাঁক আর তালুতে ছত্রাকের সংক্রমণ হতো। তাই তিনি আবারও চাকরি নেন রেস্তোরাঁয়। সেখানেই শেখেন হরেক রঙের হরেক দেশের চা বানানোর রেসিপি।
দেড় বছরের মাথায় আবারও দেশে ফিরে আসেন রাজা। নতুন কিছু করার চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। ঢাকার বিমানবন্দর এলাকায় কার ওয়াশের কাজ নেন। সংসার সাজান ত্রিশালের মেয়ে জুয়েনা সুলতানাকে বিয়ে করে। রাজা বলেন, ‘ইচ্ছা থাকলেই সব অয়। তয় সেই ইচ্ছার সাথে চেষ্টা থেকে আমি বাংলাদেশে নতুন চা নিয়ে হাজির হইছি। মানুষ খাইয়া মজা পাইব, এটাই চাই।’
প্রতিবন্ধীদের জন্য ফ্রি চা :’যখন কেউ চা খায়, প্রতিবন্ধীরা চাইয়া থাকে। মনে করে কী-ই না মজা!’ এই উপলব্ধি থেকেই প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বিনা পয়সায় স্পেশাল চা খাওয়ান রাজা।