বাগানবিলাস পরিচর্যা ও বেশি ফুল পাওয়ার উপায়
Tweet
বাগানবিলাস ( ইংরেজি নাম : Bougainvillea ; বৈজ্ঞানিক নাম: Bougainvillea spectabilis ) পুষ্প, গুল্মজাতীয় বৃক্ষের গণবিশেষ। বিভিন্ন রঙের অধিকারী এ ফুল গাছটি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। বাগান বিলাস ফুল চাষ অন্য ফুল চাষের থেকে অনেকটাই আলাদা। বাগান বিলাস ফুল গাছ চাষ করতে তুলনামূলক বেশি সার প্রয়োজন হয়।এই গাছটির বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর প্রয়োজনীয়তা বেশি থাকে। এখানে বাগানবিলাস ফুল গাছের চাষ পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো।
মাটি তৈরি
অধিকাংশ মানুষ বাগান বিলাস ফুল গাছ টবে বা ড্রামে লাগিয়ে থাকেন। টবের মাটি তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্যই বেশ কিছু নিয়ম মেনে করতে হবে। প্রথম কথা হচ্ছে বাগানবিলাস ফুল গাছ দোআঁশ মাটিতে ভালো হয় এ জন্য মাটি তৈরির সময় বেলে-দোআঁশ অথবা দোআঁশ মাটি নিতে হবে। এখন ৪০% দোঁয়াশ মাটি, ২৫% বালি, ২৫% জৈবসার, ৫% হাড় গুড়ো, ৩% নিম খৈল, ১ % সুপার ফসফেট ও ১% পটাশ একসাথে ভাল করে মিশিয়ে নিতে হবে ।
অম্লীয় মাটিতে এই ফুল খুব বেশি ফোটে। এজন্য বাগানবিলাস ফুল চাষ করার সময় মাটিতে অল্প পরিমাণ সালফার, বা কফি , বা সাদা ভিনেগার মিশিয়ে ব্যবহার করুন। এগুলো মাটিকে এসিডিক বা অম্লিয় করে তোলার জন্য ভালো কাজ করে।
টব প্রস্তুতি
বাগান বিলাস গাছের গোড়ায় কোনভাবে পানি জমতে দেয়া যাবে না। তাই টব প্রস্তত করা সময় পানি নিষ্কাসন ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। সুতারাং টবের নিচে ছিদ্রগুলো প্রথমে ইটের টুকরা দিয়ে ডেকে দিন তার পর প্রায় ২ ইঞ্চি বালি দিয়ে তার পর মিশ্রিত মাটি টবে নিয়ে পছন্দের বাগানবিলাস চারাটি লাগিয়ে দিন।
সার প্রয়োগ
সব সময় বাগানবিলাস গাছে প্রচুর পরিমাণ ফুল পেতে চাইলে সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যকীয়। অন্ততপক্ষে প্রতি মাসে একবার করে টবের বাগানবিলাস ফুল গাছে সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে জৈব সার বা শুকনো গোবর পানিতে ভিজিয়ে রেখে লিকুইড আকারে প্রয়োগ করতে হবে। রাসায়নিক সারের মধ্যে প্রতি মাসে একবার ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমওপি ও সার মিলিয়ে 1 চা চামচ পরিমাণ সার পানির সাথে মিশিয়ে টবের চারদিকে দিতে হবে। এভাবে সার প্রয়োগ করলে সারা বছরই গাছে কমবেশি ফুল আসে।
পানির সেচ
বাগান বিলাস ফুল চাষ এ পানি প্রয়োগের মাত্রা সঠিক থাকা প্রয়োজন। এই গাছ কোন ভাবেই বেশি পানি সহ্য করতে পারে না। এজন্য সতর্ক থাকতে হবে। শুধুমাত্র গাছের গোড়ার মাটি শুকিয়ে গেলে পানি দিতে হবে। অতিরিক্ত পানি অথবা মাটি একেবারে স্যাঁতসেঁতে করে ভিজিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। আর টবে বাগান বিলাস ফুল গাছের চাষ করলে অবশ্যই পানি নিষ্কাশনের জন্য ভালো ব্যবস্থা রাখতে হবে।
আলোর প্রয়োজনীয়তা
বাড়িতে যদি সূর্যের আলো পড়ে এমন জায়গার অভাব থাকে তবে অন্ততপক্ষে দিনে ৫ থেকে ৬ ঘন্টা সূর্যের আলো পড়ে এরকম একটা জায়গায় বাগানবিলাস ফুল গাছ রাখতে হবে। সঠিকভাবে সূর্যের আলো না পেলে গাছে আশানুরূপভাবে ফুল আসবে না। এছাড়া বাগান বিলাস ফুল গাছটি জিরো ডিগ্রী তাপমাত্রার নিচে ঠিক ভাবে বাঁচতে পারে না এজন্য তাপমাত্রা যদি খুব কম হয় তবে গাছটিকে ঘরে এনে রাখতে হবে।
বাগানবিলাস গাছে বেশি ফুল পাওয়ার উপায়:
(১) বছরে (মার্চ – অক্টোবর) মাসের মধ্যে ২ বার, ৪ মাস পর পর মাটি পরিবর্তন করতে হবে।
(২) দোআঁশ মাটি বা পলি মাটি ৩০%, ভালো গোবর সার ৩০% , ভার্মিকম্পোষ্ট ১৫% , হাড়ের গুড়ো ২০%, পটাশ/ছাই ৫%, মিশিয়ে মাটি তৈরী করতে হবে।গোবর সার ১ বছর পুরানো হতে হবে।
(৩) মাটি পরিবর্তন করে ৪ দিন ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে রোদে রাখতে হবে।
(৪) মাস একবার তরল সার দিলে ফুলের পরিমাণ বেশি হয়। খোল বা শাকসবজির খোসা পানিতে ৭দিন রেখে তরল করে পানির সাথে মিশয়ে দিবেন। x
(৫) একরার পানি দেওয়ার পর মাটি না শুকানো পর্যন্ত দ্বিতীয়বার পানি দিবেন না।পানি নিস্কাশন ব্যাবস্থা ঠিক রাখবেন।
(৬) বাগান বিলাস গাছের আকার ঠিক রাখার জন্য বেশি বাড়ন্ত ডাল গুলি কেটে ফেলা উত্তম। একে প্রুনিং বলে। এই পদ্ধতিতে বছরের অধিক সময় ফুল পাওয়া যায়।
পরিচর্যা
বাগান বিলাস গাছটিকে ভাল ও সুস্থ রাখতে প্রতি ৭-১৪ দিন পর পর জৈবসরা বা তরল জৈব সার দিন তবে বসন্ত কালে ও গ্রীষ্মকালে সার প্রয়োগ কম করবেন। বাগানবিলাস গ্রীষ্ম প্রধান দেশের উদ্ভিদ হওয়ায় উষ্ণ অঞ্চলে থাকতে পছন্দ করে এবং দিনে অন্তত ৪-৫ ঘন্টা খাড়া রোদ পেলে গাছের ফুল উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যায়। তবে শেষ বিকেলে যেহেতু কলিগুলো পাপড়ি মেলতে শুরু করে তাই এ সময়ের কড়া আলো তাদের পছন্দ নয়। আবার একদম হিম ঠান্ডাও তাদের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। ফলে বাগানবিলাসের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
পোকা দমন
বাগান বিলাসে ২ ধরনের পোকার আক্রমণ হয়, সুয়ো পোকা এবং সবুজ মাছি পোকা। সাবান পানি ২/৩ দিন পরপর পাতার উপরে ও নিচে জোরে জোরে স্প্রে করতে হবে যতদিন পোকা না চলে যায় । তবে পোকা দেখলেই হাত বাছাইয়ের মাধ্যমে সরিয়ে ফেলা বা মেরে ফেলা উত্তম । পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বেশি হলে অভিজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী জৈব পদ্ধতি অবলম্বনে গাছকে পোকার হাত থেকে নিরাপদ রাখা যেতে পারে।
আগাছা ব্যবস্থাপনা ও ডাল ছাঁটাইকরণ
কাংক্ষিত গাছকে সুষ্ঠভাবে বাড়তে দেয়ার জন্য ক্ষত ও রোগাক্রান্ত ডাল কেটে বাদ দেওয়া প্রয়োজন। ধারালো বিশেষ এক প্রকার ছুরি দিয়ে ডাল ছাঁটাই করতে হয়। ডাল কাটার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন থেঁৎলে না যায়। এতে গাছে ছত্রাক রোগের আক্রমণ হতে পারে। গাছের নিচে ক্ষতিকর আগাছার কারণে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
হরমোন প্রয়োগ
সহজেই রুট হরমোন দিয়ে বাগানবিলাসের চারা করা যায়। এপ্রিল থেকে জুন মাসে হাতের আঙ্গুল এর থেকে মোটা সাইজের ডাল কেটে ( ৪/৬ ইঞ্চি) রুট হরমোন দিয়ে মাটিতে লাগিয়ে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। এটি শিকড় ছাড়লে ১.৫ থেকে ২ মাস পর টবে লাগিয়ে দিতে হবে। কাটিং সব সময় গাছের গোঁড়ার দিকের ডাল থেকে নির্বাচন করতে হবে।.
গাছের মাটি বদল
দেড় থেকে দুই বছর পর পর গাছ রি পটিং বা মাটি বদলে দিলে এ গাছ ভাল থাকবে এবং সে সময় গাছের ৭৫% শিকড় রেখে বাকি ২৫% ছেটে দিতে হবে। অবশ্যই ছোট শিকড় কাটা যাবে না, পেন্সিল এর মত মোটা এবং লম্বা ধরণের শিকড়গুলো কেটে দিতে হবে। এছাড়াও দুইমাস পর পর গাছের ডাল ছেটে দিতে পারেন সুন্দর শেইপ দেবার জন্য। স্টেইনলেস ওয়্যার দিয়ে এ গাছের একটা সুন্দর আকৃতি সহজেই দেয়া যায়। ফুটন্ত বাগান বিলাস ফুলের সৌন্দর্য খুবই মনোরম যা সবার নজর কাড়ে। বাগান বিলাস ফুল রূপ সৌন্দর্যে জনপ্রিয় বলে নিসর্গবিদগণ একে অর্নামেন্টাল প্ল্যান্ট বা শোভাবর্ধনকারী গাছ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।