ফুটবলের ক্ষুদে জাদুকর লিওনেল মেসির জন্মদিন আজ।
Tweet
১৯৮৭ সালের ২৪ জুন রোজারিওতে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লিওনেল মেসি। লিওনেল মেসির বাবা হোর্হে মেসি একটি কারখানায় কাজ করতেন। আর তাঁর মা ক্লিনার হিসাবে কাজ করতেন। তবে বাবা একটি ক্লাবে কোচিং করাতেন। তাই এই সুবাদে বাড়িতে ফুটবল পরিবেশ গড়ে ওঠে। লিওনেল মেসি মাএ ৫ বছর বয়সে একটি ক্লাবে যোগ দেন। যেখান থেকে মেসি ফুটবলের প্রাথমিক পাঠ নেন। ৮ বছর বয়সে মেসি তাঁর ক্লাব পরিবর্তন করেন এবং নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজে যোগ দেন। কিন্তু এগারো বছর বয়সে মেসি গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি নামক রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগটি যদি মেসিকে কাবু করে ফেলত, তাহলে হয়তো বিশ্ব একজন মহান ফুটবলারের দেখা পেত না। এই রোগে যে কোনো মানুষের অগ্রগতি থেমে যায়। তখন পরিবারের কাছে টাকাও খুব বেশি ছিল না। ফলে মেসির চিকিৎসা করানো নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় তাঁর পরিবারের সদস্যদের। সেই সময় রিভার প্লেট থেকে মেসিকে খেলার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তারাও এই চিকিৎসার খরচ চালাতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়।
এই সময়ই মেসির ভাগ্য বদলে যায়। ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা তখন নজর রাখছিল ছোট বাচ্চাদের উপর, গোটা বিশ্বে যারা দারুণ ফুটবল খেলছে তাদের দিকে নজর রাখছিল তারা। ট্যালেন্ট হান্টের জন্য ছোট শহর, স্কুল, কলেজ এবং বিভিন্ন ক্লাবে নতুন প্রতিভার সন্ধান করতে থাকেন তাঁরা।
বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের স্পোর্টিং ডিরেক্টর কার্লেস রেজ্যাক, লিওনেল মেসির বিষয়ে জানতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাব তাঁকে সই করায়। সেই সঙ্গে রোগের ওষুধ ও চিকিৎসার পুরো খরচ দেওয়ার কথা বলা হয়। শর্ত একটাই ছিল যে মেসিকে আর্জেন্টিনা ছেড়ে বার্সেলোনায় যেতে হবে। এই শর্ত স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেন মেসির পরিবারের সদস্যরা। এর পরেই লিওনেল মেসির পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয়। ২০০৪ সালে বার্সার মূল টিমের হয়ে অভিষেক হয় মেসির। জাতীয় দলে অভিষিক্ত হয়েই লাল কার্ড দেখেন হাঙ্গেরির বিপক্ষে। জাতীয় দলের অভিষেক ম্যাচটা ভুলে জেতে চাইবেন মেসি। তারপর মেসি নিজের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন ফুটবল ফ্যানদের। তাঁর ফুটবল শৈলীতে মুগ্ধ হয়েছে গোটা বিশ্ব। ফুটবল প্রেমীরা তাঁর খেলা দেখার জন্য রাত জাগা শুরু করল। তার চোখধাঁধানো ড্রিবলিং আসক্ত করেছেন পুরো বিশ্বের ফুটবল ফ্যানদের। তার কাছ থেকে পেলমা আমরা কতশত আইকনিক মূহুর্ত। ফুটবলের ম্যাজিকাল প্যারফরম্যান্স সঙ্গে মানুষ মোহিত হয় তার সহজ সরল জীবনাদর্শে। লিওনেল মেসির খেলা দেখলে রাতের ঘুমঘুম ভাব কেটে যায় নিমিষের মধ্যে। বল পায়ে পেয়েই নিমিষেই অবিশ্বাস্যভাবে ছিটকে ফেলে দেন কয়েকজনকে।সবুজ মাঠ জুড়ে, চলে তার যুদ্ধ
বাঁ-পায়ের জাদুতে, দর্শকেরা মুগ্ধ। লিওর সঙ্গে ফুটবলের সম্পর্ক যেন অন্যরকম সুন্দর।
মেসি খেলেছে যতগুলো টুর্নামেন্ট তন্মধ্যে সব গুলো ট্রফিই তিনি জিতেছেন। একাধারে লীগ শিরোপা,চ্যাম্পিয়নস লীগ,কোপা দেল রে, স্প্যানিশ সুপার কাপ,ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ,সুপার কাপ,লীগ ওয়ান শিরোপা,ফ্রেঞ্চ লীগ ইত্যাদি।
এছাড়াও ব্যাক্তিগত অর্জনে সব ক্যাটাগরিতে সবথেকে বেশি অর্জনও মেসির নামের পাশে। ৮৮টি ব্যাক্তিগত অর্জন রয়েছে তার নামের পাশে। জাতীয় দলের হয়ে বারবার ব্যর্থ হলেও শেষ দিকে কোপা আমেরিকা জিতে ক্যারিয়ারের নতুন মাত্রা যোগ করেন।এবং পেয়ে যান একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল ট্রফি। তারপর জিতে নেন ফিনিলিসিমা।
মেসির যত অর্জন:-
(এখন পর্যন্ত যত অর্জন করেছে)
[পড়তে সুবিধার জন্য ইংরেজিতে দেওয়া হলো]
➜ 1028 Matches
➜ 807 Goals
➜ 357 Assists
➜ 62 Free Kicks
➜ 43 Trophies
➜ 57 Hat-tricks
➜ 153 Braces
◉ 2× French Ligue
◉ 1× Copa América
◉ 1× FIFA World Cup
◉ 10× Spanish League
◉ 4× Champions League
◉ 2× FIFA Club World Cups
◉ 1× Trophé des Champions
◉ 7× Spanish Copa Del Rey
◉ 8× Spanish Supercopa
◉ 3× UEFA Super Cup
◉ 1× Olympic Gold
◉ 1× Finalissima
➟ 7× Ballon d’Ors
➟ 6× Golden Boots
➟ 7× FIFA Best Player
➟ 3× UEFA Men’s P.O.T.Y
➟ 5× IFFHS Best Playmaker
➟ 2× Laureus Best Sportsman
➟ 2× Copa América Golden ball
➟3× FIFA World Cup Golden ball
➟2× Club World Cup Golden balls
➟15× Argentine Player of the year
➟ 1× Copa América Golden boot
➟ 1× Tuttosports Golden boy
➟ 9× La Liga Best Player
➟ 6× UCL Topscorer
➟ 4× Onze d’Ors
➟ 8× Pichichis
And many more….++++
মেসির ফুটবল ক্যারিয়ারে সবথেকে বাজে সময় আসে বার্সা টু পিএসজিতে মুভ করে।বার্সা ইকোনমি সমস্যায় পরে যাওয়ায় মেসিকে ফ্রি তে ছেড়ে দেয় এবং মেসি পিএসজিতে চলে যায়।মেসি পিএসজিতে দুইটি সিজন খেলেছে।
২২ কাতার বিশ্বকাপ টিই ছিল মেসির একমাত্র লক্ষ্য। যাত্রা শুরুতেই সৌদির সাথে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। তারপর এক একটি ম্যাচ ফাইনাল এর মত করে খেলে বিশ্বকাপ জিতে নেয় মেসির আর্জেন্টিনা। পুরো টুর্নামেন্টে মেস্যার অনবদ্য পারফরম্যান্স এ তিনি হন আসরের সেরা খেলোয়াড়। আর এরই মধ্য দিয়ে মেসি তার ক্যারিয়ারে পূর্ণতা পেয়ে যান। ফুটবল সম্পূর্ণভাবে শেষ করে ফেলেন।
দুনিয়ার সমস্ত ‘মেসি’ একদিন লিওনেল হবে |
ইরাকে নিজের ঘরের কাছে ফুটবল খেলতে গিয়ে ভুল করে গ্রেনেডে লাথি মেরে দেয় দশ বছরের ছেলেটা। পা উড়ে যায় কিন্তু ফুটবল খেলা থামেনি৷ আলি আল জাইদাউই এক পায়ে খেলতে থাকে ‘বিউটিফুল গেম’। যুদ্ধ বিধ্বস্ত শহরে ধুলোমাখা এক টিভি সেটের ওপারে লিওনেল মেসি যখনই পায়ের জাদু দেখায়, আলি নিজের পাকে ফিসফিস করে বলে: “একটা পা দিয়ে ও যুদ্ধ জেতা যায় বুঝলি বোকা”।
আলি ও ওর মতো আরো অনেক ইরাকি ছেলে যাদের হাত বা পা বোমায় উড়ে গেছে, যাদের জীবন থেকে ফুটবলটা ও ছিনিয়ে নিয়েছে যুদ্ধ বিমান, তাদের নিয়ে একটা সিনেমা হয়। “মেসি বাগদাদ” বলে। এরকম একটা ছবি হয়েছে আর এতোগুলো ছেলে এক পায়ে ফুটবল খেলে মেসির জামা পরে, এটুকু শুনেই লিওনেল মেসি ঠিক করে এদের সাথে দেখা করবে। আলি সেদিন এক পায়ে হেঁটে আসে রাজপুত্রের সামনে। রাজপুত্র ওর পা’টা ছুঁয়ে দেখে। দুজন শিশু একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্বপ্নপূরণের ছোট গল্প তো এভাবেই লেখা হয়।
সিরিয়ার মেয়ে নুজিন মুস্তাফা। ১৮ বছর বয়স, সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত, হুইলচেয়ারে ঘোরে। কিন্তু আইসিস এর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সেই হুইলচেয়ার চেপেই পালিয়ে আসে ইউরোপে নিজের বোনের সাথে শরনার্থী হিসেবে। ব্যাগে সামান্য কিছু জামাকাপড় ছাড়াও লিও’র একটা ময়লা ছবি থাকে সবসময়। লিওনেল মেসির চোখ দেখলে নাকি ওর সমস্ত মনখারাপ দূর হয়ে যায়। লাজুক মেয়ের স্বপ্ন ছিল মেসিকে সামনে থেকে একবার দেখার। ইচ্ছের কথাটা লিওনেল জানতে পারে আর দুই বোনকে খেলা দেখতে চলে আসতে বলে স্পেন। হুইলচেয়ারের সামনে স্বপ্নের পুরুষ এসে হাঁটু মুড়ে বসে, হাত ধরে রাজকুমারীর। রূপকথার গল্প তো এরকমই হওয়ার কথা। ওখানে বোম, আইসিস, সৈনিক, ঘরের আগুন থাকবে কেন?
আফগানিস্তানের গজনি প্রদেশের ছয় বছরের ছেলে মুর্তাজা আহমেদি। গৃহযুদ্ধ, তালিবান রাজ, বিদেশী সেনা, কার্পেট বোম্বিং আর চরম দারিদ্র্য দুর্দশার মাঝে ও একচিলতে আরাম ছিল মেসির খেলা দেখা। কাগজের মন্ড পাকিয়ে ফুটবল খেলতো। প্লাস্টিকের বস্তা কেটে আর্জেন্তিনার নীল-সাদা ১০ নম্বর জার্সিতে মেসির নাম লিখে মাঠে নামতো। ছবিটি ভাইরাল হয়ে যায়। মেসি সেটা জানার পর তাঁর সই করা আর্জেন্তিনা দলের একটি জার্সি উপহার দেয় মোর্তাজা’কে।
এই মোর্তাজা, আলি, নুজিনরাই তো মেসি। দশ নম্বর জার্সি গায়ে রোজ জীবন যুদ্ধ লড়তে যাচ্ছে। লাতিন আমেরিকা হোক বা মধ্যপ্রাচ্যে, এরা সব্বাই মেসির মতো জীবনের ময়দানে ভেলকি দেখিয়ে জিতে যাচ্ছে, টিকে থাকছে। মেসির ঢোলা একটা জার্সি পরে ট্রেনে রোজ যে ছেলেটা হজমিগুলি,লাইটার, সানগ্লাস, ছুড়ি, কাঁচি বিক্রি করে বা যে মেসি ময়লা পরিষ্কার করে ম্যানহোলে নেমে বা রোজ ভোরবেলা শৈল্পিক ভাবে খবরের কাগজটা বারান্দা তাক করে ছুঁড়ে দেয়, এরা সব্বাই একদিন লিওনেল হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
হয়তো সেই স্বপ্নে গোলপোস্ট নেই, হয়তো সেই স্বপ্নের রেফারি আরো কড়া, বল পায়ে আরো কম সুযোগ পাওয়া যায় কিন্তু ওরা প্রত্যেকে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে চলেছে একটা বিউটিফুল লাইফের জন্য। দিনহাটা থেকে দামাস্কাস, সুন্দরবন থেকে সান দিয়াগো। একটা সন্ত্রাসবিহীন সুন্দর ভবিষ্যৎ, মাথার উপর ছাদ, মা রান্না করে দিচ্ছে, বাবা আদর করে বল কিনে দিচ্ছে, পড়াশোনার জন্য স্কুল আছে, শোয়ার জন্য বেডরুম, খেলার জন্য স্পোর্টস শ্যু। পৃথিবীর সব মোর্তাজা, আলি, নুজিনরাই লিওনেল মেসিকে দেখে জীবনের ম্যাচটা জেতার সাহস পায়। মেসি মাঠের বাইরে সেই সাহসটা জাস্ট একের পর এক দিয়ে যায় সান্টাক্লজের মতো, উপহার হিসেবে।
আজ সেই ইচ্ছে-পূরণের গাছ, সেই সান্টাক্লজের জন্মদিন। আজ সাহস – স্পর্ধা জুগিয়েছিল যে সেই জামাটির জন্মদিন। ভালো থেকো রাজপুত্র! অক্ষয় থাক ওই ১০নম্বর জার্সি