ঘোলের পুষ্টিগুণ
Tweet
দুধের স্বাদ ঘোলে না মিটলেও, দুধের সব পুষ্টিগুণ কিন্তু ঘোলে সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায়, তা–ও আবার বাড়তি মিল্কফ্যাট বা ননি বাদ দিয়ে। ঘোল বলি আর মাঠা বলি বা ইংরেজিতে বাটার মিল্ক; যুগ যুগ ধরেই এই উপকারী আর সুস্বাদু পানীয় সারা বিশ্বের মানুষই পান করে আসছে আগ্রহভরে। আর গ্রীষ্মের এই দাবদাহে যখন তৃষ্ণায় ছাতি ফাটে, লেবু চিপে এক গ্লাস ঘোল পান করতে গিয়ে কারও আর দুধের স্বাদের জন্য আফসোস হবে না, এ কথা হলফ করে বলা যায়।
বা মাঠা কী?
পূর্ণ ননিযুক্ত দুধ বা ঘনীকৃত ননি থেকে চার্নিং বা শীতল ঘূর্ণন পদ্ধতিতে মাখন আলাদা করে ফেলার পর যে চর্বি ছাড়া জলীয় অংশ রয়ে যায়, তা–ই আসলে ঘোল। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই পানীয় ‘চাস’ নামেও পরিচিত। বহু যুগ আগে, বাণিজ্যিক পরিসরে মাখন তৈরির জন্য দুধের ননি ফেলে রাখা হতো প্রাকৃতিকভাবে সামান্য গাঁজিয়ে ফেনিয়ে তোলার জন্য। এতে করে মাখন আলাদা করা সহজ হতো। তারপর এই ফার্মেন্টেড বা গাঁজানো ননি একেবারে ঠান্ডা করে জোরে ঘূর্ণি তুলে বা চার্নিং করে মাখন তুলে নেওয়া হতো। এতে যে বাটার মিল্ক পাওয়া যেত, তা কিছুটা কড়া ও নোনতা স্বাদের হতো মাখনের মতো। আর এই প্রক্রিয়ায় অপাস্তুরিত দুধ ব্যবহার করা হতো বলে এই ঘোল পান করার কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েই যেত। বর্তমানে যে পানযোগ্য বাটার মিল্ক সারা দুনিয়ায় সবার প্রিয়, তা আসলে পাস্তুরিত দুধে বাইরে থেকে যোগ করা দই অথবা ছানার পানি থেকে পাওয়া প্রোবায়োটিকস বা উপকারী ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ফার্মেন্টেশন ঘটিয়ে বানানো হয়।
ঘোল আর মাঠার মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে বলেই জানা যায়। দই অথবা ঘোলের সঙ্গে পরিমাণ মতো চিনি আর মসলা মেশালেই মাঠা তৈরি হয়। আবার সাদা ঘোলকে কোথাও কোথাও মাঠা বলে।
কোথায় পাবেন ঘোল?
উপমহাদেশে আবহমান খাদ্যসংস্কৃতিতে ঘোলের চিরন্তন এক আবেদন আছে। গ্রীষ্মপ্রধান এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এক দিকে হজমে সহায়ক, আরেক দিকে প্রশান্তিদায়ক ঠান্ডা পানীয় হিসেবে ঘোল খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশে মুন্সিগঞ্জের ভাগ্যকূল বাজারের বিভিন্ন আদি মিষ্টান্ন ভান্ডারের ঐতিহ্যবাহী ঘোলের সুনাম তো সর্বব্যাপী। কয়েক পুরুষ ধরে এই প্রসিদ্ধ ঘোল তাঁরা বানিয়ে আসছেন নিজস্ব প্রণালিতে। তবে এ ক্ষেত্রে মূলত ঘোল জ্বাল দেওয়া দুধে দই যোগ করে ঠান্ডা করে চার্নিং বা শীতল ঘূর্ণন পদ্ধতিতেই বানানো হয়। স্বাদ বাড়ানোর জন্য লেবুর রস দিয়ে পরিবেশন করা হয় প্রাণজুড়ানো ও অত্যন্ত উপাদেয় এই ঘোল।
মুন্সিগঞ্জসহ বৃহত্তর ঢাকার সব স্থানেই আনাচকানাচে ঘোল পাওয়া যায় কাকডাকা ভোরে। ঢাকার মধ্যে পুরান ঢাকার নাজিরবাজার, নাজিমুদ্দিন রোড, বংশালসহ বহু জায়গায় ভোরবেলা মাঠা-মাখন বিক্রি হয়। মাঠা বা ঘোলবিক্রেতার কাছ থেকে লেবু চিপে এক গ্লাস ঘোল পান করার পর হালকা চিনি ছড়িয়ে ছানাটুকু টুক করে মুখে পুরে দেওয়ার মজাই আলাদা। তবে আজকাল প্রায়ই ঘোলের স্বাদ ভেজাল দইয়ের শরবত দিয়ে মেটাতে চান কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। আর স্বাস্থ্যকর পরিবেশে পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করে বানানো ঘোল কি না, সেটাও আগে যাচাই করে নিতে হবে।
সুস্বাস্থ্যের জন্য ঘোল বা মাঠা
ঘোলের স্বাস্থ্যগুণ দুধের চেয়ে কম তো নয়ই, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘোল দুধের তুলনায় বেশি উপকারী। এতে লাইভ কালচার প্রোবায়োটিকস বা অন্ত্রের জন্য অত্যন্ত উপকারী ব্যাকটেরিয়ার প্রাকৃতিক জোগান থাকে ভরপুর। এসব উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে সমষ্টিগতভাবে বলা হয় মাইক্রোবায়োম যা আমাদের সুস্থ পরিপাকতন্ত্র, রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম এবং দেহের পুষ্টির পরিপূর্ণ ভারসাম্য রক্ষায় অতুলনীয়।
এক কাপ ঘোলে প্রায় আট গ্রাম প্রয়োজনীয় প্রোটিন থাকে। আর ঘোলের ব্যাকটেরিয়া প্রধান দুগ্ধজাত প্রোটিন তথা ক্যাসেইনকে ঘনীভূত করে ফেলে বলে কার্যকরীভাবে তা দেহে শোষিত হয়। ১ কাপ ঘোলে দৈনিক চাহিদার ২২ শতাংশ ক্যালসিয়াম, ২৯ শতাংশ রিবোফ্লাবিন ও ২২ শতাংশ ভিটামিন বি১২ থাকে। অথচ মাখন তুলে নেওয়ায় ঘোলে দুধের তুলনায় অর্ধেকের কম চর্বি থাকে। এতে ঘোল যেমন সুপাচ্য হয়, তেমনি যাঁদের চর্বি খেতে নিষেধ, যেমন হৃদ্রোগ বা অতিরিক্ত কোলেস্টেরলের সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁরাও নিশ্চিন্তে ঘোল পান করতে পারেন। এতে অবস্থিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক এনজাইমের প্রদাহরোধী ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্টরূপে কার্যকর ভূমিকা থাকার ব্যাপারেও বহু গবেষণালব্ধ প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বাড়িতেই তৈরি করুন ঘোল
করোনার এই সংক্রমণকালে বাইরের ঘোল না খাওয়াই ভালো। খুব সহজেই ঘরোয়া পদ্ধতিতে পরিবারের সবার জন্য তৈরি করে নেওয়া যায় ঘোল বা মাঠা। এর জন্য দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে পূর্ণ ননিযুক্ত ঘন দুধে পরিমাণমতো টাটকা টক দই মিশিয়ে কিছুক্ষণ ঢেকে রেখে দিতে হবে। দই টাটকা না হলে তাতে বীজ বা ব্যাকটেরিয়া গোত্রের অনুঘটক কার্যকরভাবে উপস্থিত থাকবে না। এবারে কয়েক টুকরো বরফ দিয়ে খুব জোরে হ্যান্ড বিটার বা ডাল ঘুঁটনিতে ঘূর্ণি তুলতে হবে দইমেশানো ঠান্ডা দুধে। দেখা যাবে ওপরে মাখন উঠে আসছে। প্রয়োজন মতো মিশ্রণটি আরও ঠান্ডা করে বা বরফের টুকরো ব্যবহার করে এভাবে চার্নিং করতে করতে সব মাখনই আলাদা হয়ে যাবে। এবারে ছেঁকে নিয়ে এই মজাদার ও স্বাস্থ্যকর মাঠা বা ঘোল লেবুর রস মিশিয়ে পরিবেশন করা যায় পরিবারের সবাইকে।
মহামারির এই দুর্দিনে নিজের দেহকে দুর্গরূপে গড়ে তোলার আসলে কোনো বিকল্প নেই। আর শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার জন্য প্রতিদিন প্রোবায়োটিকস বা উপকারী ব্যাকটেরিয়াসমৃদ্ধ খাদ্য বা পানীয় গ্রহণের ব্যাপারে আজকাল পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকেরা খুবই জোর দিচ্ছেন। তাই বাংলা বাগধারায় ঘোল খাওয়া বলতে যতই ঠকে যাওয়ার কথা বোঝানো হোক না কেন, এক গ্লাস ঘোল বা মাঠাকে নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় জায়গা দিলে লাভটা আখেরে আমাদেরই হবে। তাই এক গ্লাস সুস্বাদু ঘোলেই মেটানো যাক দুধের সব পুষ্টিগুণ।