আলোকিত রন্ধনশিল্পী স্মৃতি সাহা
Tweet
স্মৃতি সাহার জন্ম চাঁদপুর জেলার ছবির মত সাজানো-গোছানো, ঝকঝকে সুন্দর গ্রাম রামপুরে। রামপুরের ছায়া শীতল নিভৃত পরিবেশে ১৯৭০ সালের অক্টোবরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বর্ষায় টইটম্বুর জলাশয়, নবান্নের উৎসব, কুয়াশাঢাকা সকাল আর নির্মল হাওয়া বাতাসের আশীর্বাদ নিয়েই কেটে গেছে সম্ভান্ত্র শৈশব। যৌথ পরিবারে সবার আদরে বেড়ে ওঠা তার জীবনে একটা অন্যরকম প্রাপ্তি। স্মৃতি সাহা আজও চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পান সূদুর অতীতের সেই বকুল, শিমুল, সোনালু ফুল আর ছাতিমের গন্ধে ভ’রা নিভৃত গ্রাম রামপুর আর স্বর্গীয় সময়, আহা শৈশব!
স্থানীয় দি বিবেকানন্দ বিদ্যাপিঠ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার হাতেখড়ি। এরপর তৃতীয় শ্রেনীতে উঠে চলে যান রামপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয় সমাপ্ত করে রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পরেই “মকবুল আহমদ মহিলা কলেজ”। এই কলেজে ভর্তির কিছুদিন পরেই বিয়ে। স্মৃতি সাহার কলেজ জীবন যেন ছোট গল্পের মতোই।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ধাপ মাঝপথেই সাঙ্গ করে পারিবারিক আয়োজনে বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। পড়ালেখার মতো সহজ সরল সমীকরণ থেকে হঠাৎ করেই মুখোমুখি সংসার নামক কঠিন ত্রিকোণমিতি। বয়স সবেমাত্র সতেরো কি আঠারো, কুড়ি হতে এখনো বাকি দুই তিন বছর। এই কোমল কাঁধ এখনো সংসারের ভার বহন করার মতো শক্ত হয়ে ওঠেনি। এমন দ্বিধা ও সংশয়পূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন স্মৃতি সাহার স্বয়ং স্বামী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী দীপক সাহা। সদাহাস্যজ্বল স্মৃতি সাহা বিয়ের পর পরেই স্বামীর আশীর্বাদের হাত মাথার উপরে পেয়ে যেন হয়ে ওঠেন শুচিস্মিতা।
হাসি আনন্দে সংসারের প্রতি শতভাগ নিবেদিত থেকে তিনি সন্তানদেরকে বড় করতে সময় দিয়েছেন। তিনি চাইলেই হয়তো পড়াশোনা শেষ করে একটা ভালো চাকরি নিয়ে নিজেকে সফল করতে পারতেন অন্যভাবে। কিন্তু স্মৃতি সাহা নিজেকে সফল করার চেয়ে খুঁজেছেন সার্থকতা। তারই ফলস্বরূপ সন্তানেরা আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্র। একমাত্র ছেলে MBA শেষে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছেন। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ডাক্তার আর ছোট মেয়েটা কানাডায় University of Manitoba তে বিকম পড়ছে।
স্মৃতি সাহা পছন্দ করেন গল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি রান্না বিষয়ক বই পড়তে। এজন্য যখন যেখানে বেড়াতে গেছেন চেষ্টা করেছেন সেখান থেকেই বিভিন্ন রকমের রান্না বই সংগ্রহ করতে। দেশ-বিদেশে বেড়াতে গিয়ে আঞ্চলিক খাবারের স্বাদ গ্রহণের পাশাপাশি রেসিপি জানার চেষ্টাও করেছেন। ভালো লাগার মতো বিষয় হলো বই সংগ্রহ করতে করতে তিনি ছোট্ট একটি ব্যাক্তিগত পাঠাগার গড়ে তুলেছেন।
পুরোদস্তুর সংসারী হলেও ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন স্মৃতি সাহা। তিনি এখন পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন ইন্ডিয়া, নেপাল, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিংগাপুর, নিউজিল্যান্ড ও আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণকালে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার বাইরেও তিনি দেখেন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির ধারক মানুষ, আবার মানুষে-মানুষে সংস্কৃতিগত ভিন্নতা। ভ্রমণ ও প্রকৃতি থেকে স্মৃতি সাহা যে জ্ঞান অর্জন করেন তা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের অনেক ঊর্ধ্বে।
সংসার ও সংসারের বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করে স্মৃতি সাহা নিজেকে আত্মবিশ্বাসী নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অন্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই নিজে সম্মানিত হয়েছেন। এইভাবে আত্মসম্মানবোধ এবং আত্মবিশ্বাসে সমৃদ্ধ হয়ে তিনি নিতান্তই শখের বসে একদিন আত্মনিয়োগ করে বসেন রান্নার কাজে।
প্রচলিত রান্নাগুলোকেই আরও একটু গঠনমূলক ভাবে মানে ও স্বাদে ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন উপকরণের সংমিশ্রণ আরও দক্ষভাবে ব্যবহার করে খাবারের পুষ্টিগুণ বজায় রাখার চেষ্টা করেন। এইভাবে বিভিন্ন সময়ে রান্না বিষয়ক নানান ফেসবুক গ্রুপে নিজের তৈরিকৃত খাবারের ছবি পোস্ট করে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন।
২০১৭ সালে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল জিটিভিতে কুকিং ষ্টার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন নিজের যোগ্যতা যাচাই করতে। এই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করার পরে স্মৃতি সাহার আত্মবিশ্বাস উঠে যায় তুঙ্গে। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের প্রশংসা ও অনুপ্রেরণায় তিনি পরবর্তীতে পিঠা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। লবী রহমান ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত এই পিঠা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নেন দুর্দান্ত দাপটের সাথে।
এরপর আর কখনো পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৮ সালে আমরা কুঁড়ি সংগঠন থেকে তিনি পেয়েছেন আলোকিত নারী সম্মাননা।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি থেকে শুরু করে বেশকিছু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন। মাছরাঙা টিভির টক শো’তে উপস্থিত থাকা ছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে তার রেসিপি ছাপা হচ্ছে নিয়মিত।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ও আঞ্চলিক রান্না তিনি নিজে খেয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশীয় রান্নার স্বাদ ও গুণগত মানের ভিন্নতা বোঝার চেষ্টা করেছেন। দেশীয়, আঞ্চলিক ও বিভিন্ন মহাদেশীয় খাবারে নিজের অভিজ্ঞতার সাথে রন্ধন বিষয়ক বিভিন্ন বইপুস্তক থেকে অর্জিত জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করে বাসায় চর্চা করেছেন হরেক পদের রান্না। এছাড়াও রন্ধনশিল্পে নিজের আগমন সুসংহত করতে তিনি দেশের নামকরা সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়েছেন প্রশিক্ষণ।
নানাবিধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রন্ধন বিষয়ক উচ্চতর জ্ঞান আহরণ করে তিনি আলোকিত বাংলাদেশ, আয়না সময়, লাইফ স্টাইল, সাম্প্রতিক দেশকাল, স্পুন ম্যাগাজিন, লুক মি, আনন্দধারা এবং অনন্যা’তেও রেসেপি দিয়ে আসছেন নিয়মিত।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী হাসিনা আনছার সম্পাদিত ঐতিহ্যবাহী রান্নাঃ সেরা ১০০ রেসিপি বইয়ে তার একটি রেসিপি স্থান পেয়েছে। রন্ধন শিল্পকে ভালবেসে ও কেন্দ্র করেই নারী উদ্যোক্তা ও আলোকিত রন্ধনশিল্পী এগিয়ে যেতে চান বহুদূর। রন্ধনশিল্পের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা থেকেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এই শিল্পে। ব্যাক্তিগত চাওয়া পাওয়ার হিসেব ঊর্ধ্বে রেখে তিনি একজন প্রকৃত শিল্পীর মতোই অবদান রেখে যেতে চান রন্ধনশিল্পে।