মরুভূমির ‘সাম্মাম’ চাষে আশার আলো দেখছেন কৃষক
Tweet
মরুদেশ সৌদি’র সুমিষ্ঠ ফল ‘সাম্মাম’ (রকমেলন) এর চাষ এখন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় শুরু হয়েছে। স্থানীয় পাঁচপোতা গ্রামের ইলিয়াস মোল্লা ও তার সহোদর আফজাল মোল্লার চিংড়ি ঘেরের মাচায় ঝুলছে ফলটি। ক্রিম রং’র এ ফল নতুন আশা জাগিয়েছে। ফলে ইলিয়াস-আফজালের দেখাদেখি এখন রেহেনা বেগম ও বাবুল গাজীসহ অনেকেই এ ফল চাষে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
উপজেলার খর্ডুয়া ইউনিয়নের পাঁচপোতো গ্রামের চাষি ইলিয়াস মোল্লা ও তার ভাই আফজাল মোল্লার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৌদি আরব-সহ মধ্যপ্রাচ্যে ধুসর মরুভূমির ‘সাম্মাম’ খুবই জনপ্রিয় ও মূল্যবান ফল। এর বাইরের আবরণ খুব শক্ত হলেও ভেতরে নরম, অনেকটা পেঁপেঁর মতো। দেখতে খানিকটা তরমুজ বা বাঙ্গি’র মতো হলেও ফলের গায়ে এক রকম জাল-জাল দাগ থাকলেও সুঘ্রাণযুক্ত মিষ্টি এই ফলটি। এই প্রথম ডুমুরিয়া অঞ্চলে এ ফলের ভালো ফলন হয়েছে।এরইমধ্যে এলাকায় মুখে মুখে সাম্মামের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। এই ফল দেখতে প্রতিদিন মানুষ পাচপোতা বিলে আসছেন।
সাম্মাম চাষের ধরন সম্পর্কে জানা গেছে, বৈশাখ মাসে ঘেরের আইলে অসময়ের তরমুজ, কুমড়া বা লাউ চাষের মতো করে জৈব, টিএসপি ও এমওপি সার দিয়ে এক হাত অন্তর মাদা তৈরি করে বীজ রোপণ করতে হয়।
পাঁচপোতা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘের টলটলে পানিতে ভরা। এর আইলের ধার দিয়ে বানানো হয়েছে মাচা। বাঁশ ও নাইলনের সুতা দিয়ে তৈরি সেই মাচাতে ঝুলছে নানা জাতের অসংখ্য তরমুজ। সেগুলো নেটের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে রাখা। এক পাড়ের একটা অংশজুড়ে তরমুজের মতো মাচায় ঝুলছে রকমেলন। কুমড়াগাছের মতো লতানো গাছ। দুই ভাই পানিতে নেমে মাচা উঁচু করে দিচ্ছেন। সঙ্গে চলছে অন্যান্য পরিচর্যা।
ইলিয়াসদের ঘেরের পাড়ে দুই ধরনের রকমেলন হয়েছে। একটির গায়ে হলুদ মসৃণ খোসা। খানিকটা পেঁপের মতো। আর অন্যটির খোসা খসখসে, রং হালকা বাদামি ধূসর। বড় বাতাবিলেবু বা ছোট গোল কুমড়ার আকারের। দু’টি জাতের ফলের ভেতরটা অনুজ্জ্বল কমলা বর্ণের। ভেতর অনেকটা বাঙির মতো। তবে দুটি ফলই খেতে খুবই মিষ্টি, সুস্বাদু ও সুগন্ধযুক্ত।
সাম্মাম চাষে আগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে চাষি ইলিয়াস মোল্লা বলেন, ‘গত ৩ বছর ধরে আমরা দুই-ভাই আমাদের চিংড়ি ঘেরে তরমুজ চাষ করে থাকি। চলতি বছর আমরা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে লাভজনক নতুন নতুন সবজি চাষের ধারণা পেয়েছি। চুকনগর বাজার থেকে প্রতিটা ১২ টাকা দরে ১৫টা বীজ কিনে এনে রোপণ করি। বীজ রোপণের ৪-৫ দিন পর চারা বের হয়ে এক মাসের মাথায় গাছ মাচায় উঠে ফুল আসতে শুরু করে। মোট ৭৫ দিনে পাকা ফল কেটেছি। আমার ১৫টা গাছে এ বছর ৪০টারও বেশি ফল হয়েছে। গত সপ্তাহে খুলনা কাচা বাজার আড়তে ৬০ টাকা কেজি দরে ১৮টি পাকা সাম্মাম বিক্রি করেছি। প্রতিটা ফল গড়ে ৩ কেজি ওজন হয়েছে।’
সাম্মামের পাশাপাশি তারা ক্ষেতে হলুদ তরমুজের মতো দেখতে ‘রিয়া’ নামের আরও একটি বিদেশি ফল চাষ করেছেন। তারও স্বাদ ও ফলন ভালো হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ইলিয়াস।
কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মরুপ্রধান দেশের জনপ্রিয় ফল রকমেলন। আরব অঞ্চলের মানুষ একে সাম্মাম নামেই জানে। এ ছাড়া খরবুজ, খরমুজ, কেন্টালোপ, সুইট মেলন, নেটেড মেলন নামেও ফলটি বিভিন্ন দেশে পরিচিত। এই বিদেশি ফলের কয়েক রকম জাত আছে। ফলটির খোসা বেশ পুরু হওয়ায় সংরক্ষণ ও পরিবহনে সুবিধা রয়েছে।
চাষি আফজাল মোল্লা বলেন, ‘ঘেরের পাড়ে হয় কি না, তা পরীক্ষার জন্য মাত্র ১০ শতক জায়গায় বীজ পুঁতেছিলেন জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ফলের তেমন একটা রোগবালাই নেই। গাছে সামান্য সার ও কীটনাশক দিতে হয়েছে। ঘেরের পাড়ে হওয়ায় সেচের ঝামেলাও তেমন নেই। লাগানোর মাসখানেক পরেই গাছে ফল আসতে শুরু করে। প্রতিটা গাছে পাঁচ-সাতটা করে ফল আসে। সব মিলিয়ে ৬০-৬২ দিনের মধ্যে ফল একবারে পরিপক্ব হয়েছে। হলুদ জাতের ফল দুই থেকে আড়াই কেজি ওজনের আর খসখসে গোল জাতের ফলটা হয়েছে তিন থেকে চার কেজি ওজনের।’
ঘেরের আইলে প্রথমবারের মতো বিদেশি এ ফল উৎপাদনের খবর পেয়ে দেখতে আসছেন আশপাশের কৃষকেরা। কেউ কেউ ভবিষ্যতে নতুন জাতের এ রসালো ফল উৎপাদনের জন্য পরামর্শও নিচ্ছেন।
তেমনই একজন চাষি বাবলু গাজী বলেন, ‘আমি ঘেরের আইলে বিভিন্ন সবজি ও তরমুজ লাগিয়েছি। আমাদের অঞ্চলে ঘেরের পাড়ে লাগানো নতুন ফলটি কেমন হয়েছে, তা দেখতে এসেছি। বিদেশি এই ফল দারুণ হয়েছে। আগামী মৌসুমে অন্তত এক একর জায়গায় এই ফল চাষ করব।’
অপর সবজি চাষি রেহেনা বেগম বলেন, ‘সাম্মাম রসালো ও মিষ্টি, তবে অন্যসব ফলের চেয়ে দারুণ স্বাদ।’
এলাকার সবজি চাষি আবদুস ছালাম বলেন, ‘আমাদের এলাকায় সৌদি আরবের ফল সাম্মাম ফলেছে শুনে বা দেখে আমরা দারুণ আশাবাদি। ভালো দাম ও স্বাদের কথা শুনেছি। আগামি বছর আমরাও সাম্মাম চাষ করবো।’
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘সাম্মাম বা রকমিলন এলাকায় সম্পূর্ণ নতুন হওয়ায় আমরা তাদেরকে সব রকম সহয়তা দিয়েছি। এর বিশেষ কোনো পরিচর্যারও দরকার হয়নি। আগামি বছর ডুমুরিয়ায় এর চাষ বাড়বে। আর সাম্মামের আবরণ শক্ত হওয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায় বলে বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।