জ্বলে ওঠার আগেই নিভে যেতে পারে পর্যটন!
Tweet
পর্যটন খাতে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে- গত আড়াই দশক ধরে পর্যটন বিষয়ক যে কোনো আলোচনায় ও আয়োজনে এ বাক্যটি উচ্চারিত হয়েছে। একই সাথে পর্যটনের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার পরিকল্পনা থেকে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছে- এ তথ্যও জানানো হয়েছে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন।
এই লেখাটি লেখার আগ পর্যন্ত পর্যটনের সাথে সম্পৃক্ত ও দায়িত্বশীল কেউ নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি বাংলাদেশের পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য কী। অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এর থেকে ফায়দা তুলে আনতে রাষ্ট্রের মহাপরিকল্পনায় কি কি আছে। বস্তুত পর্যটন বলতে রাষ্ট্র কি বোঝে তাও স্পষ্ট নয়। ফলে পর্যটন খাতে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা আর এ খাত নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা- দুটোই কথাই অর্থশূন্য কথার কথায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের পর্যটন খাত কেমন আছে, কতখানি এগিয়েছে, কতখানি পরিবর্তন এসেছে- খুব সাধারণ প্রশ্নগুলোর কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর নেই। কারণ, বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য কী আর লক্ষ্য অর্জনে পরিকল্পনা কী এবং কোন কোন কার্যক্রম চলমান রয়েছে সেসব সম্পর্কে কোনো আলোচনা শোনা যায়না, বস্তুনিষ্ঠ তথ্যও অপ্রতুল। অপার সম্ভাবনা আর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে মহাপরিকল্পনা আছে- এমন শব্দসমষ্টি শুনে সুখ সুখ বোধ হলেও পরক্ষণেই প্রশ্ন জাগে এই ‘সুখ সুখ বোধ’ই কি পর্যটন খাতে প্রাপ্তি!
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে পর্যটনের সম্ভাবনা কতটা বা কতটুকু তা নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন থাকলেও বাস্তবে গবেষণায় তেমন আগ্রহ নেই সংশ্লিষ্টদের। গবেষণার ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়নেও সমান অনাগ্রহ। ফলে দেশের অধিকাংশ পর্যটনগন্তব্যগুলো অগোছালো। ফলত দেশের পর্যটনগন্তব্যগুলোকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হচ্ছেনা।
ইতোমধ্যে জনপ্রিয় পর্যটনগন্তব্যগুলো ধীরে ধীরে ধ্বংসও হচ্ছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে সংরক্ষণের চেষ্টা নেই। নতুন নতুন পর্যটনগন্তব্য খুঁজে খুঁজে বের করছে দেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষ, ওইসব গন্তব্যগুলোও সংরক্ষণ ও বিপননের পরিবর্তে রেষ্টুরেন্ট আর দোকান লিজ দেওয়াতেই প্রশাসনের সকল চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। অথচ পর্যটনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য পর্যটনগন্তব্যগুলো সংরক্ষণ জরুরী। পর্যটনের সম্ভাবনা বলতে যদি অধিক পর্যটক আকৃষ্ট করা বোঝানো হয় তবে যেমন পর্যটনগন্তব্যগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন তেমনই প্রয়োজন পরিকল্পিত বিপনন।
বাংলাদেশের মানুষ এখন দেশের পর্যটনগন্তব্যগুলোতে ভ্রমণ করছে, বছর বছর পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে- এর অর্থ এই নয় যে পর্যটন এগিয়েছে। দেশের মানুষের কাছে পর্যটন বা ভ্রমণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, এই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এবং এগিয়ে যাওয়াও হচ্ছে সম্পূর্ণ পরকিল্পনাহীনভাবে। এই পরিকল্পনাহীন অগ্রগতি থেকে কোনো অর্জন সম্ভব নয়, বরঞ্চ খাতটি ধীরে ধীরে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের একমাত্র কোরাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। অতিরিক্ত স্থানীয় বাসিন্দা আর বাড়তি পর্যটকের ভারে জনপ্রিয় এই পর্যটনগন্তব্যের আজ নাজুক অবস্থা। অথচ দ্বীপটির এমন অবস্থা হওয়ার কথা ছিল না। যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে শুধু দেশে নয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম একটি সুন্দর পর্যটনগন্তব্য হতে পারতো সেন্ট মার্টিন।
পরিকল্পনাহীন এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে নিশ্চিতভাবেই পর্যটনগন্তব্যগুলো হুমকির মুখে পরছে। দেশের কোন পর্যটনগন্তব্যের ধারণক্ষমতা কত- এর কোনো হিসেব নেই। অথচ ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পর্যটক আকৃষ্ট ও ভ্রমণের ব্যবস্থা করা উচিত। একইভাবে, অতিরিক্ত পর্যটকের পর্যটন পিপাসা মেটাতে কোনকোন পর্যটনগন্তব্যগুলোকে প্রমোট ও বিপনন করা হবে।
একজন পর্যটক বিষয়ক চিন্তক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, পর্যটনকে থ্রাস্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা করে দ্রুত পর্যটন নীতিমালা এবং অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে মহাপরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বাড়তি পর্যটক আকর্ষণের মাধ্যমে পর্যটনের অগ্রগতির একচোখা নীতি বাদ দিয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে পর্যটনগন্তব্যগুলো সংরক্ষণ ও যথাযথ ব্যবহারের দিকে। প্রত্যেকটা পর্যটনগন্তব্যের ট্যুরিস্ট ক্যারিং ক্যাপাসিটি (টিসিসি) নির্ধারন করে সেই অনুযায়ী পর্যটককে পর্যটনের সুযোগ দিতে হবে। পরিকল্পনাহীন পর্যটন উন্নয়ন ও অতিরিক্ত পর্যটকের ভারেও যে বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনা জ্বলে ওঠার আগেই নিভে যেতে পারে- এ ভাবনাটা গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে, ভাবতে হবে পর্যটনের স্বার্থেই।
আবু রায়হান সুমন, পর্যটন বিশ্লেষক