আশ্রয়হীনদের খুঁজে বেড়ান যে মহৎপ্রাণ
Tweet
নগর জীবনের শত কোলাহলে যেখানে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে মানবতা, প্রজন্মের মাঝেও তৈরি হচ্ছে মানবিক বৈকল্য- সময়ের এই আকুলতায় পৃথিবীতে এখনো অনেক মানুষ মূল্যবোধের আলোকবর্তিকা হয়ে জেগে ওঠে। হয়ে ওঠে মানবতার বাতিঘর। মানবিকতা যখন ক্ষত-বিক্ষত অমানবিক অবয়বে, তখনই নিজস্ব সত্তায় জেগে ওঠে কেউ কেউ।
মিল্টন সমাদ্দার (৩২) তাদেরই একজন। গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। এ যুগে সন্তানরা যেখানে নিজের পিতা-মাতাকে সময় দিতে চায় না, এমন দুঃসময়ে মানবতার এক অন্যরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মহৎপ্রাণ মিল্টন সমাদ্দার। সমাজের অসহায় ও আশ্রয়হীন বৃদ্ধদের খুঁজে বেড়ানো তার নেশা ও পেশা হয়ে গেছে। নিজের ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া বৃদ্ধাদের ভরণপোষণ করান তিনি।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে রাস্তা থেকে অসুস্থ অসহায় বৃদ্ধদের পরম মমতায় বুকে তুলে নেন মিল্টন সমাদ্দার। তার সঙ্গে সহযোগিতা করছেন লিটনের স্ত্রী মিঠু হালদার। শুধু বৃদ্ধ নয় মানসিক ভারসাম্যহীন ও প্রতিবন্ধীদেরও নিজেদের ছায়াতলে আশ্রয় দেন। মৃত্যুর পর তাদের দাফন-কাফনের দায়িত্বও পালন করেন সেবক এই দম্পতি।
কুড়িয়ে পাওয়া এসব বৃদ্ধা ও ভারসাম্যহীন এবং প্রতিবন্ধীদের নিয়ে রাজধানীর কল্যাণপুর এলাকায় একটি বাড়ির ছয় তলার নিচ তলার দুই ইউনিট ও আরেকটি দোতলা বাড়ির নিচ তলার পুরো ইউনিট নিয়ে তৈরি করছেন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার নামক এক বৃদ্ধাশ্রম। বর্তমানে মোট ১৬টি রুমে ৪২ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন সেখানে। যাদের মিল্টন ও তার স্ত্রী বাবা-মা বলেই ডাকেন।
মিল্টন ও তার স্ত্রী দু’জনেই পেশায় নার্স। তাদের উপার্জিত অর্থ দিয়েই চলে বৃদ্ধাশ্রমটি। নার্সিং এজেন্সি নামে একটি এজেন্সি রয়েছে মিল্টনের। যেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবা দেওয়া হয়। সেখান থেকে মিল্টনের যে আয়, আর জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটে কর্মরত তার স্ত্রী যে অর্থ পান তাতেই চলে মিল্টনের এই বৃহৎ সংসার। নিজেরা সেই বৃদ্ধদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেন।
মিল্টনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের। মিল্টন বলেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে যা আয় তার সবটুকু এই বৃদ্ধাশ্রমে ব্যয় করেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে ১০ জন লোক কাজ করে। তাদেরকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। ভাড়া হিসাবে প্রতিমাসে গুনতে হয় ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। একজন চিকিৎসক সবসময় তাদের দেখাশোনা করেন। তাকে প্রতিমাসে দিতে হয় ১৬ হাজার টাকা। তাদের জন্য ওষুধ কিনতে প্রতিমাসে ৭৫ হাজার টাকা দিতে হয়। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা গুনতে হয়।
মহতি এই উদ্যোগের শুরুটা কেমন হয়েছিল জানতে চাইলে মিল্টন বলেন, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার মোহাম্মদপুরে রাস্তার পাশে রোগেশোকে জরাজীর্ণ এক বৃদ্ধাকে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন তার স্মৃতি হারিয়েছে। দেরি না করে দ্রুত তাকে বাসায় নিয়ে যান। বৃদ্ধা সেখানে মিল্টনের পরিবারের সদস্যের মতোই থাকেন।
এরপরই মিল্টনের মাথায় চেপে বসে মহতি এই উদ্যোগ। শুরু করেন আরো সম্প্রসারণের পরিকল্পনা। মানবতার কল্যাণের এই কাজ নেশা হয়ে যায় তার মনে। শুরু করেন বৃদ্ধদের খোঁজ। সন্তান পরিত্যক্ত, অসুস্থ, স্মৃতিভ্রষ্ট, রোগাক্রান্ত বয়স্ক মানুষ দেখলেই নিয়ে আসেন তিনি। ভাড়া নেন তাদের জন্য একটি আলাদা টিনশেড ঘর। মাস ছয় যেতে না যেতেই সেখানে স্থান সঙ্কুলান হয় না। তাই একটি বাড়ির ছয় তলার নিচ তলার দুই ইউনিট ও আরেকটি দোতলা বাড়ির নিচ তলার পুরোটা নিয়ে রাখতে থাকেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। বর্তমানে মোট ১৬টি রুমে ৪২ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন। যাদের মিল্টন ও তার স্ত্রী বাবা-মা বলেই ডাকেন।
মিল্টন জানান, আমি ও আমার স্ত্রী যা আয় করি তার পুরোটাই আমরা আমাদের বাবা-মায়ের পেছনে খরচ করি। আমরা কোনো টাকা সঞ্চয় করি না। চার বছরের একটি ছেলে আছে আমাদের। ওর যখন ছয় মাস বয়স তখন থেকেই আমরা এ কার্যক্রম শুরু করি। আমার এ কাজে আমি অনেক শান্তি পাই। আমি চাই যারা বয়স্ক বাবা-মাকে অবহেলা করে, দেখে না, তারা এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক।
মিল্টনের এই বৃদ্ধাশ্রমে এখন পর্যন্ত ঠাঁই হয়েছে ৭৬ জন বাবা-মায়ের। এর মধ্যে মারা গেছেন প্রায় ১৬ জন। আর বাকিদের তাদের পরিবারের সদস্যরা মিল্টনের ফেসবুক পেজে দেখে শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন। মিল্টনের কারণেই অনেক পরিবারের মুখে হাসি ফুটেছে তাদের হারিয়ে যাওয়া বাবা-মাকে খুঁজে পেয়ে।
তবে এখন শুধু মিল্টনই নয়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খুঁজে পেতে সহায়তা করেন আশপাশের মানুষরাও। পুলিশ পথচারী যে যেখানে অসহায় বৃদ্ধদের দেখতে পান তারাই মিল্টনকে জানান। মিল্টন তাদের গিয়ে নিয়ে আসেন। আবার অনেকে নিজেরাও পৌঁছে দিয়ে যান অসহায় বৃদ্ধদের। তবে যারা পৌঁছে দেন তারাও আর পরে খোঁজ না নেওয়ায় বেশ আক্ষেপ করেন মিল্টন।
বৃদ্ধাশ্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে মিল্টন বলেন, আগামীতে অসহায় বৃদ্ধা ও নিজের কবরের জন্য একটি করবস্থান তৈরি করব। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে। সরকারের কাছে বিশেষ কিছু চাওয়ার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না তেমন কিছু চাওয়ার নেই। সরকার যদি সবকিছু করে তাহলে আমরা কী করব। আমরা এসব ছোটখাটো কাজ করব। আর সরকার দেশের বড় বড় উন্নয়ন কাজ করবে। এখানেও আরেক অনন্য চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হলো মিল্টনের কথায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে মহৎপ্রাণ এমন মিল্টনদের নজির কমবেশি পাওয়া যায়। তবে মানবিক বৈকল্যের এই দুঃসময়ে এমন মিল্টনদের খুব বেশি প্রয়োজন। এগিয়ে চলুক মহৎপ্রাণ মিল্টনদের এই সতত অভিযাত্রা, এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।