ক্রীড়া পর্যটনে বদলে যাচ্ছে সৌদি আরব
Tweet
বদলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের চেনা রূপ। ২০১৬ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো টেকসই উন্নয়নে স্ব-নির্ধারিত ভিশন বা ‘রূপকল্প-২০৩০’ বাস্তবায়ন করছে। এরই ফলশ্রুতিতে প্রায় সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। চিরচেনা সৌদি আরবেরও বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটছে।
সৌদি যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমান ‘সৌদি রূপকল্প-২০৩০’ সম্পর্কিত বাণীতে জানান, প্রতিটি সাফল্যের গল্প একটি লক্ষ্য দিয়ে শুরু হয় এবং শক্তিশালী ভিতের উপর নির্ভর করে সফলতা লাভ করে।
মহান আল্লাহ সৌদি আরবের জমিকে তেলের চেয়েও মূল্যবান হিসেবে উপহার দিয়েছেন উল্লেখ করে সৌদি যুবরাজ জানান, রূপকল্প-২০৩০ এর প্রথম স্তম্ভ হল আরব ও বিশ্ব মুসলিমের হৃদয় হিসেবে সৌদি আরবের মর্যাদা সমুন্নত রাখার সংকল্প। সৌদি আরব হল দুটি পবিত্র মসজিদের ভূমি, পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থান এবং কাবা (ক্বিবলা) এর দিক যেখানে এক বিলিয়নেরও বেশি মুসলমান প্রার্থনা করে। রূপকল্পের দ্বিতীয় স্তম্ভ হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ পাওয়ার হাউসে পরিণত হওয়া। তৃতীয় স্তম্ভটি হল সৌদির অনন্য কৌশলগত অবস্থান যা তিনটি মহাদেশ- এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকাকে সংযুক্ত করে সৌদিকে একটি বৈশ্বিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করছে। মূল বৈশ্বিক জলপথের মধ্যে ভৌগলিক অবস্থানের ফলে সৌদি আরবকে বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এবং বিশ্বের প্রবেশদ্বার করে তুলেছে।
সৌদি রূপকল্প-২০৩০’এর প্রধান তিন স্তম্ভের উপর নির্ভর করে বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্যগুলির মধ্যে রয়েছে সৌদি বেসরকারি খাতকে উন্নত করা, আয়ের খাতের বৈচিত্র্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধ ও টেকসই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় সৌদি আরবের ফলপ্রসূ উপস্থিতি নিশ্চিতে বিনিয়োগ করা। রূপকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের মাধ্যম হিসেবে পর্যটন শিল্পকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
সৌদি রূপকল্প অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ সৌদিদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান তৈরী, সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং বহুমাত্রিক আয়ের খাত হিসেবে সৌদি আরবকে বিশ্বমানের পেশাদার ক্রীড়া অনুষ্ঠান আয়োজনের আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠার করা হবে। সৌদি অর্থনীতির বৈচিত্রকরণের যাত্রায় পরিবেশ বান্ধব নীতি, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতি, উদ্যোক্তা এবং উচ্চ-প্রযুক্তিসম্পন্ন শিল্পের সাথে সংগতিপূর্ণ করে ক্রীড়া খাতকে গড়ে তোলা হচ্ছে।
হজ্জ ও ইসলামিক পর্যটন গন্তব্য হিসেবে সৌদি আরবের অবস্থান অদ্বিতীয়। সৌদি আরবের হাজার হাজার ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে এবং ছয়টি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট থাকার পরও রূপকল্প ২০৩০এর মাধ্যমে বহুমাত্রিক পর্যটন গন্তব্য হিসেবে সৌদি আরবের রূপান্তর ঘটছে। বহুমাত্রিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সৌদি আরবের রূপান্তরের সূচনা ঘটে ক্রীড়া আয়োজন এবং ক্রীড়া কেন্দ্রিক পর্যটনের মাধ্যমে।
সৌদি রূপকল্প-২০৩০ ঘোষণার প্রায় দুই বছর পর ২০১৮ সালে সৌদি আরবের জেদ্দায় কিং আবদুল্লাহ স্পোর্টস সিটিতে অবস্থিত কিং আবদুল্লাহ ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেইনমেন্টের (ডাব্লিউডাব্লিউই) ‘রয়্যাল র্যাম্বল’ আয়োজিত হয়। রেসলিংয়ের এই আয়োজন ছিল সৌদি আরবের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি সৌদি ভিশন ২০৩০ এর আওতায় ডব্লিউডব্লিউই (WWE) এবং সৌদি জেনারেল স্পোর্টস অথরিটির মধ্যে ১০ বছরের কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রথম আয়োজন। সৌদি আরবের পক্ষ থেকে ওই আয়োজনের লক্ষ্য ছিল বিশ্ববাসীকে সৌদি আরবের বদলে যাওয়ার সংবাদ পৌছে দেওয়া। ২০১৮ সালেই সৌদি আরবের রিয়াদে প্রধম দিরলিয়াহ ইপ্রিক্স ফরমুলা ই ইলেকট্রিক কার রেস আয়োজিত হয়। একই বছরে ব্রিটেনের ক্যালাম স্মিথ জেদ্দায় স্বদেশী জর্জ গ্রোভসকে হারিয়ে WBA সুপার-মিডলওয়েট শিরোপা এবং বিশ্ব বক্সিং সুপার সিরিজের মুকুট জয় করেছিলেন।
২০১৯ সালে সৌদি আরবে বছরব্যাপী ক্রীড়া আয়োজনে মুখর ছিল। ওই বছরের জানুয়ারিতে জেদ্দায় সুপার কোপা ইটালিয়ানার হাই ভোল্টেজ ম্যাচে জুভেন্টাস ১-০ গোলে এসি মিলানকে পরাজিত করে। ফেব্রুয়ারীতে সৌদি আন্তর্জাতিক গলফ টুর্নামেন্টে ডাস্টিন হফ জয়লাভ করেন। মার্চ মাসে বিএমএক্স ব্যাটেল অব দ্য চ্যাম্পিয়নস স্কেটবোর্ডিং টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯এর ডিসেম্বরে সৌদি আরবে প্রথম দিরিলিয়াহ টেনিস কাপ, সুপার কোপা ইটালিয়ানার জুভেন্টাস বনাম লাজলো ফুটবল ম্যাচ, বিশ্ব হ্যাভিওয়েট বক্সিং টাইটেল ‘ক্ল্যাশ অন দ্য ডিউনস’ ম্যাচে এন্থনি জশোয়া বনাম এন্ডি রুলজ জুনিয়ারের লড়াই অনুষ্ঠিত হয়।
কোভিড সংক্রমণের কারণে বিশ্বব্যাপী স্থবিরতা দেখা দিলে সৌদির ক্রীড়া অঙ্গনেও এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি সত্ত্বেও ২০২০ সালে সৌদি আরব সুপারকোপা ডি স্পেনা’র ফুটবল ম্যাচ, বিশ্বের সবচে বেশী প্রাইজমানির ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা এবং প্রথম সৌদি আন্তর্জাতিক নারী গলফ প্রতিযোগিতা এবং প্রথম নারী ফুটবল লীগ আয়োজন করে। উল্লেখ্য, সৌদি আরব রূপকল্প ২০৩০ এর মাধ্যমে নারীর প্রতি অবস্থান পরিবর্তন করছে। সৌদি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দাবী অনুযায়ী ২০১৫ সালের তুলনায় বর্তমানে খেলাধুলায় সৌদী নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কোভিডের অবরুদ্ধ পরিস্থিতি কাটিয়ে সৌদি আরব ২০২১সালের এপ্রিলে এক্সট্রিম ই-রেস আয়োজন করে। সৌদি গ্র্যান্ড প্রিক্স আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ইভেন্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। মাত্র আট মাসে নির্মিত, জেদ্দার সমুদ্রের তীরে উচ্চ-গতির সার্কিটটি এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে দ্রুততম F1 ট্র্যাক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নভেম্বরে আয়োজিত প্রথম সৌদি গ্রান্ড প্রিক্সের মুকুট জয় করেন লুইস হ্যামিলটন। ২০২০ সালে ২৪ দলের নারী ফুটবল লিগ শুরুর পরের বছর প্রথম নারী আঞ্চলিক ফুটবল লিগ আরম্ভের মাধ্যমে বিভিন্ন খেলাধুলায় নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারী হতে মার্চের মধ্যে এক্সট্রিম ই রেস সেকেন্ড সিজন, ডাকার র্যালী, সুপার কোপা এস্পেনা ফুটবল ম্যাচ এবং সৌদি গ্রান্ড প্রিক্স আয়োজন করেছে সৌদি আরব। আগস্টে বিশ্ব হ্যাভিয়েট বক্সিং টাইটেল ‘লোহিত সাগরে উন্মাদনা’ ম্যাচে কিং আবদুল্লাহ স্পোর্টস সিটিতে বক্সিং ইতিহাসের সবচেয়ে কাঙ্খিত রিম্যাচগুলির একটিতে প্রাক্তন দুইবারের ইউনিফাইড চ্যাম্পিয়ন জশোয়ার বিরুদ্ধে ইউসিক তার WBA, IBF, WBO এবং IBO বেল্ট রক্ষা করার জন্য মুখোমুখি হয়।
২০১৬ থেকে ২০২২- ছয় বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সৌদি আরবে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কিছু ক্রীড়া অনুষ্ঠান সফলভাবে আয়োজন কারার মাধ্যমে সৌদি আরব ক্রীড়া আয়োজক রাষ্ট্র হিসেবে নিজের পরিচিতি, যোগ্যতা ও দক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে সৌদি আরবকে বহুমুখী পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রদর্শন করেছে। প্রধান ক্রীড়া অনুষ্ঠানগুলো আয়োজনে অংশীদারিত্ব, বিনিয়োগ, স্পনসরশিপ এবং কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।
সৌদি আরব এএফসি নারী এশিয়ান কাপ ফুটবল ‘২০২৬ আয়োজনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়া এশিয়ান কাপ ফুটবল ২০২৭, ২০২৯ সালে সৌদি আরবের পরিকল্পিত মেগাসিটি নিওম (NEOM)-এ এশিয়ান উইন্টার গেমস এবং ২০৩৪ সালের এশিয়ান গেমসের আয়োজক দেশ হবার লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে।
সৌদি আরবের জিডিপিতে ২০১৬ সালে ক্রীড়া খাতের অবদান ছিল ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সৌদি আরবে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আয়োজনের পরিমাণ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে জিডিপিতে ক্রীড়া খাতের অবদান ৬.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌছে। আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়ং প্রতিবেদন অনুসারে সৌদি আরবে ক্রীড়া ইভেন্ট শিল্পের মূল্য বার্ষিক 8 শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রীড়া এবং ক্রীড়া পর্যটনের হাত ধরে বদলে যাচ্ছে সৌদি আরব।