অর্গানিক খাদ্য কতটা অর্গানিক!
Tweet
অর্গানিক চাষ পদ্ধতির ধারণাটি নতুন নয়। বিংশ শতকের (১৯০০ সাল) শুরুতে স্যার অ্যালবার্ট হাওয়ার্ড কৃষি গবেষক হিসেবে দীর্ঘদিন ভারতে কাজ করেন। ভারতের ঐতিহ্যবাহী ও টেকসই চাষাবাদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। তখনও ভারতের কৃষিতে সিনথেটিক/কৃত্রিম সারের প্রয়োগের ব্যপক্ প্রচলন ঘটেনি। প্রায় একই সময়ে মার্কিন কৃষি বিজ্ঞানী এফ. এইচ. কিং এবং অস্ট্রিয়ান আধ্যত্মবাদী দার্শনিক রুডলফ স্টেইনার অর্গানিক ফার্মিংয়ের বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেন।
১৯৪০ সালে জে. আই রোডেল এবং তার ছেলে রবার্টের উদ্যোগে ‘অর্গানিক গার্ডেনিং এন্ড ফার্মিং’ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ হতে শুরু করেন। ১৯৬২সাল, মার্কিন সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী (মেরিন বায়োলজিস্ট) রাচেল কারসনের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বইটি প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বা নিরব বসন্ত হলেও পরিবেশ আন্দোলনে বইটি সরব বসন্তের সূচনা করে।
অর্গানিক চাষ পদ্ধতিতে সিনথেটিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহার, ফসলের সাথে সহায়ক ফসল, জমির উর্বরতা রক্ষা ও বৃদ্ধিতে মৌসুম ভেদে ফসলের আবর্তন এবং জৈবিকভাবে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি না করে ফসল/শস্য উৎপাদন করা হয়। তবে ফসল ও শস্যকে শতভাগ অর্গানিক পণ্যে পরিণত হতে উৎপাদন শুরুর পূর্ব হতে ক্রেতার হাতে পৌছানো পর্যন্ত অনেকগুলো কঠিন ধাপ অতিক্রম করতে হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশেও অর্গানিক খাদ্য ও পণ্যের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে।সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেট ভিত্তিক যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে পশ্চিমা বিশ্বের ঝোঁকের ঢেউ খুব দ্রুতই দেশের কূলে-উপকূলে আছড়ে পড়ে। ঢেউ আছড়ে পড়াটা খারাপ নয়, আছড়ে পড়ার আগ পর্যন্ত মূল ঝোঁকটা ভাঙতে ভাঙতে নিজের রূপ হারিয়ে প্রায় সময়েই বিকৃত হয়ে ওঠে।
চলতি শতকের গোড়ার কথা, ফাস্টফুড খাওয়া তখন মার্কিন কালচারের অংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সৌখিন চলচ্চিত্র নির্মাতা ‘সুপার সাইজ মি’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এই তথ্যচিত্রে শারিরীক ও মানসিক ক্ষেত্রে ফাস্টফুডের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবগুলো তুলে ধরা হয়। তিনি দেখান ফাস্টফুড খেলে কিভাবে ওজন এবং মানসিক অবসাদ দুটোই দ্রুত বাড়ে, সাথে যোগ হয় অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি। ‘সুপার সাইজ মি’ প্রচারের পর ফাস্টফুডের নামি-দামি ব্রান্ডগুলো তাদের ‘সুপার সাইজ’ অফারগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। পশ্চিমে যখন ফাস্টফুডের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে তখন আধুনিক হবার বাসনায় আমরা ফাস্টফুডকে কালচারে পরিণত করছিলাম। এই দেরীর কারণ সম্ভবত তখন যোগাযোগ প্রযুক্তি এতটা সাবলীল ছিল না।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। তবে পশ্চিমে এই প্রবণতা নতুন নয়। গত চার দশক ধরে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে খাদ্যাভাস পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচিত ও চর্চিত হচ্ছে। গত শতকের আশির দশকে পশ্চিমা দেশগুলোর স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাদ্যাভাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। তারা চর্বিযুক্ত সব খাবার (স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় চর্বিসহ) বর্জন করে শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এখন চিনির নাম শুনলেই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ আঁতকে উঠলেও তখন শর্করা হিসেবে প্রচুর পরিমাণ চিনি খাওয়া হতো। নব্বই দশকেও এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে।
গত শতকের আশি এবং নব্বই দশক জুড়ে বাজারে ‘লো-ফ্যাট’ এবং ‘ফ্যাট-ফ্রি’ খাদ্যের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ে। খাদ্য উৎপাদন ও বিপননকারী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রবণতাকে পূঁজি করে নতুন নতুন পণ্য বাজারে আনে, ভোক্তাদের আকৃষ্ট করে।
নতুন শতকের শুরুতে শর্করার প্রতি ভালবাসায় ধ্বস নামে, খাদ্যভাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। চর্বিযুক্ত ও শর্করা জাতীয় খাদ্যের পরিবর্তে স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রোটিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা শুরু হয়। ‘সুপার সাইজ মি’র মত তথ্যচিত্র আর বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে চর্বি/ফ্যাট ও শর্করা জাতীয় খাদ্য শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর তা জেনে মানুষ বিস্মিত হয়, আতঙ্কিত হয়। ফলে চর্বির মত শর্করা বর্জনের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এই ধারাটি বৈশ্বিক প্রবণতায় রূপ পেয়েছে।
বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্রতি আমাদের দেশেও আগ্রহ বাড়ছে। স্বাস্থ্য সচেতনরা স্বাস্থ্যই সম্পদ ও সকল সুখের মূল – এই বিশ্বাসের প্রতি আস্থাবান হচ্ছে। শরীরকে সুস্থ্য, সবল, সতেজ এবং রোগমুক্ত রাখার জন্য শারীরিক পরিশ্রম, হাটাহাটি, ব্যায়াম, সাঁতার এবং বিশ্রামের প্রতিও যত্মবান হচ্ছে। খাদ্যাভাস পরিবর্তনের চেষ্টাও চলছে। অর্গানিক খাদ্যের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে।
বাস্তব প্রেক্ষাপটে অর্গানিক চাষ পদ্ধতিটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দাবী করলেও দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের পরিমাণ কম। এই প্রেক্ষাপটে অর্গানিক চাষ পদ্ধতি কোনো সুফল দিবে না। কারণ, অর্গানিত চাষ পদ্ধতিতে পরিবেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে শস্য উৎপাদনে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিদ্যমান সীমাবদ্ধতার কারণে উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পায়।
অর্গানিক চাষ পদ্ধতি ফলপ্রসূ না হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ শস্য বা পণ্যের মূল্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অর্গানিক পণ্যের মূল্য অ-অর্গানিক পণ্যের তুলনায় অন্তত চার থেকে পাঁচগুণ বেশী দামে বিক্রি করলে কৃষক ও বিপননকারী মুনাফা করতে পারবে। কারণ, একই সমান বিনিয়োগে অ- অর্গানিক পণ্যের তুলনায় অর্গানিক পণ্য উৎপাদিত হবে কম, অর্গানিক পণ্য দ্রুত পঁচনশীল, পরিবহন ও প্যাকেজিং ব্যায়ও উল্লেখযোগ্যভোবে বেশী হবে। ফলে মুনাফা নিশ্চিতের জন্য চার থেকে পাঁচগুণ বেশী দামে পণ্য বিক্রি করতে হবে। কিন্তু এই দামে খুব স্বল্প সংখ্যক ক্রেতাই অর্গানিক খাদ্য কিনতে উৎসাহ বোধ করবে।
বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ‘অর্গানিক’ লেবেলের যেসব পণ্য পাওয়া যায় তার অধিকাংশই অর্গানিক নয়। বিভিন্ন সূত্র হতে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন নামকরা খাদ্য উৎপাদন ও বিপনন প্রতিষ্ঠানের বহু খাদ্যই নিরাপদ নয়। অথচ খাদ্যের মোড়কে বিভিন্ন সার্টিফিকেশনের উল্লেখ থাকে। এছাড়া প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খাদ্য মানেই অর্গানিক খাদ্য নয়। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হলেও অর্গানিক হয়ে ওঠার জন্য উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে অর্গানিক খাদ্য কেন্দ্র করে চলছে অর্গানিক প্রতারণা, এসব খাদ্যের অধিকাংশেই অর্গানিক নয়, নিরাপদও নয়।