মুর্শিদাবাদ পর্যটন (দ্বিতীয় পর্ব)

Share on Facebook

মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব না বুঝে ভ্রমণে গেলে অল্প কিছু আনন্দ আর পা ব্যাথা ছাড়া তেমন কিছুই পাওয়া যাবে না। মুর্শিদাবাসের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ঐতিহাসিক নিদর্শন। আগের পর্বে হাজার দুয়ারী প্যালেস ও সিরাজ মদীনা সম্পর্কে কিছু প্রকাশের পর এবার বাচ্চাওয়ালী কামান, ইমামবাড়া ও খোশবাগ নিয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করা হলো-

বাচ্চাওয়ালী কামান

১৬৪৭ সালে রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরে জনাধন কর্মকার নামে এক ব্যক্তি কামানটির নির্মাতা।জানা গেছে, তৎকালীন সম্রাটের নির্দেশে কামানটি জাহাঙ্গীরনগর থেকে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার পথে ভাগীরথী নদীতে নৌকাডুবি ঘটে। ফলে তলিয়ে যায় কামানটি। এর প্রায় দুইশ বছর পর ভাগীরথী নদী থেকে বালি তুলে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার হাজার দুয়ারী প্যালেস নির্মাণের সময় কামানটি পাওয়া যায়। তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার মনসদে ছিলেন মীর জাফরের পঞ্চম বংশধর হুমায়ুন ঝাঁ। কামানটি তিনি পরবর্তীতে হাজার দুয়ারীতে সংরক্ষণ করেন। হাজার দুয়ারী প্যালেস ও ইমামবাড়ার ঠিক মাঝখানে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও  ১৬ হাজার ৮৮০ পাউন্ড ওজনের কামানটি রাখা হয়েছে।

কথিত আছে, কামানটি পাওয়ার পর নবাব হুমায়ুনের নির্দেশে ১৮ কেজি বারুদ ভরে ফায়ার করার পর এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। কামানের শব্দে চারপাশের ১০ মাইলের মধ্যে যে সব মায়েরা গর্ভবর্তী ছিলেন, তাদের পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। সেই থেকেই এর নাম হয়ে যায় ‘বাচ্চাওয়ালী কামান’। স্থানীয়রা মনে করেন, এটার জন্য মায়েদের পেটে থাকা অসংখ্য বাচ্চাকে বলি দিতে হয়। তাই এটাকে বলা হয় ‘বাচ্চাওয়ালী কামান’। জনাধন কর্মকারের তৈরি চারটি কামানের মধ্যে একটি এখনও ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সংরক্ষিত আছে।

 

ইমামবাড়া

বর্তমান হাজারদুয়ারি প্রাসাদ প্রাঙ্গণের মধ্যে যে কয়েকটি পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে তারমধ্যে ইমামবাড়া একটি। এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় ইমামবাড়া। দোতলা এই ইমামবাড়াটি ২০৭ মিটার দীর্ঘ। বলা হয়ে থাকে, প্রথমে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলাই এটিকে কাঠ দ্বারা নির্মাণ করান। এরপর কেটে গেছে আরও একশো বছর। ১৮৪৬ সালে একবার এতে আগুন লেগে সম্পুর্ণ ইমামবাড়াটি পুরে যায়। বাংলা তখন ব্রিটিশদের দখলে। মসনদে তাদেরই অধীনত নবাব হুমায়ুন ঝাঁ’র ছেলে নওয়াব নাজিম মনসুর আলী। ১৮৪৭ সালে মনসুর আলী ফেরাদুন ঝাঁ প্রায় সাত লাখ রুপি ব্যয়ে এই ইমামবাড়াটি তখন পুনর্নির্মাণ করেন।

মহররমের মাসের এক থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত ইমামবাড়াটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তখন উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিয়া সম্পদায়ের লোকজন এখানে আসেন। মহরম মাসের শেষ দিন সকাল বেলা ইমামবাড়া থেকে একটি শোভাযাত্রা বের হয়। এতে হাসান-হোসেনের নকল মরদেহ শবাধারে বহন করে নগ্নপদে বুক চাপড়ে হায় হাসান, হায় হোসেন বলে শোকার্ত হৃদয়ে কারবালা প্রান্তর পর্যন্ত তিন কিমি রাস্তা ৬-৭ ঘণ্টায় অতিক্রম করে যা অতি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক এক দৃশ্যের জন্ম দেয়।

যদিও এই অনুষ্ঠানের নবাবি আমলের জৌলুস আজ আর নেই। মহরম মাসের প্রথম দশদিন এখানে জাঁকজমকপূর্ণ মেলা হয়।

 

খোশবাগ

খোশ শব্দের অর্থ আনন্দ ও বাগ শব্দের অর্থ বাগান। অর্থাৎ আনন্দ-বাগান। নবাব আলীবর্দী খাঁ নিজ সমাধির জন্য জীবদ্দশায় খোশবাগ প্রস্তুত করেছিলেন। এর সুরক্ষার জন্য চতুর্দিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে বেষ্টনী গড়ে নানা প্রকারের মনোরম পুষ্পবৃক্ষাদি রোপণ করেছিলেন।

খোশবাগে উঁচু পাথর বাধানো কবরে শুয়ে আছেন নবাব আলীবর্দী খাঁ। তার বামপাশে শুয়ে আছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। পলাশীর প্রান্তরে মীর জাফরের বেঈমানিতে পরাজয় বরণের পর নানা ঘটনার পরিক্রমায় হত্যা করা হয় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। পরে তাকেও সমাহিত করা হয় খোশবাগে, নানা আলী বর্দি খাঁর কবরের পাশে। অনেকগুলো কবরের মধ্যে কেবল নবাব আলীবর্দী খাঁর কবর সবচেয়ে বড় ও উঁচু। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কবরের পাশে পাথরে খোদাই করে নাম লিখে আলাদা করা আছে।

সিরাজউদ্দৌলার পাশেই তার ভাই মির্জা মেহেদী, সিরাজউদ্দৌলার পায়ের দিকে তার স্ত্রী বেগম লুৎফা ও সঙ্গী আলেয়ার কবর রয়েছে। একইসঙ্গে খোশবাগে শুয়ে রয়েছেন নবাব নবাব আলীবর্দী খাঁর কন্যারা, নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের সদস্যরা, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যাকারী মোহাম্মাদী বেগ, ইতিহাসে ধিকৃত গোলাম হোসেন, সিরাজউদ্দৌলাকে ধরিয়ে দেওয়া মাঝি ও তার পরিবারবর্গসহ পরবর্তীতে ঢাকা, পাটনা ও অন্যান্য জায়গায় অবস্থানরত সিরাজউদ্দৌলার আত্মীয়-স্বজন, যাদের ধাওয়া দিয়ে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের কবর রয়েছে।

খোশবাগে একটি মসজিদ রয়েছে। খোশবাগে অবস্থাকালে এই মসজিদে আলীবর্দী খাঁ নামাজ আদায় করতেন। চমৎকার নির্মাণশৈলীতে গড়ে তোলা খোশবাগে মূল দরজাসহ সাতটি ফটক রয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, নবাব আলীবর্দী খাঁ খোশবাগে অবস্থানকালে এখানে বসেই ভাগীরথীর ওপারে মতিঝিলে বড় মেয়ে ঘষেটি বেগমের বাড়ি দেখতেন। এজন্য ফটকগুলো মতিঝিলের সোজাসুজি করে নির্মাণ করা হয়েছিল

Leave a Reply