ঘুরে আসুন অতিথি পাখির মেলা থেকে
Tweet
হঠাৎ করেই একটু-আধটু কুয়াশার চাদর পরে নামতে শুরু করেছে শীত। শীতকাল আসবার আগেই প্রকৃতিতে এসে গেছে আসন্ন শীতের আমেজ। প্রকৃতির যখন এই অবস্থা, তখনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সাজছে নতুন রূপে। সকালের বিন্দু বিন্দু শিশিরভেজা ঘাস আর সূর্য্যর উঁকি দেওয়ার মুহূর্তে ঘাসের ওপর শিশিরের ফোঁটা মোহনীয় করে তোলে যে কাউকেই।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো অতিথি পাখি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শীত আর অতিথি পাখি যেন জড়িত ওতপ্রোতভাবে। শীতের সময়ে সেখানে পাখির কিচির-মিচির আওয়াজের সঙ্গে বসবাসের দুর্লভ সুযোগ মেলে ক্যাম্পাসবাসীর। লাল শাপলার মাঝে দূর থেকে আসা বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির বাহারি খেলায় মেতে ওঠার দৃশ্যে লেকগুলো এখন জানান দিচ্ছে গ্রাম বাংলার চিরচেনা সেই মনোরম পরিবেশ।
প্রতি বছর উত্তরের শীতপ্রধান দেশ সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, সিনচিয়াং ও ভারত থেকে হাজার হাজার অতিথি পাখি দক্ষিণ এশিয়ার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশে আসা পাখিদের ৮-৯ শতাংশ আসে এই ক্যাম্পাসে। মূলত, অক্টোবরের শেষ ও নভেম্বরের প্রথম দিকেই এরা এদেশে আসতে শুরু করে। আর মার্চের শেষ দিকে তারা ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। বাংলাদেশের মানুষ শখ করে যাযাবর এসব পাখিকে ডাকে গেস্ট বার্ড/মাইগ্রেটরি বার্ড বা অতিথি পাখি। অসম্ভব বন্ধুসুলভ এ পাখিগুলোর অনেকটাই আমাদের দেশি হাঁস প্রজাতির।
শহরের ব্যস্ত জীবনের যান্ত্রিকতা আর ধুলাবালি থেকে মুক্ত এই ক্যাম্পাসটিতে পাখির ছোঁয়া পেতে প্রতিদিন ভীড় জমান শত-শত পাখিপ্রেমীরা। হাজারো অতিথি পাখির কলকাকলি, জলকেলী, খুনসুটি, পুরো ক্যাম্পাসের আকাশে মনের সুখে দলবেঁধে উড়ে বেড়ানো। এর সৌন্দর্য নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না কখনো। লাল শাপলার মাঝে ধূসর রঙের হরেক প্রজাতির পাখি মেলে ধরেছে জাবি ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে।
সাধারণত
হিমালয়ের উত্তরের দেশ সাইবেরিয়া,
চীন, মঙ্গোলিয়া ও নেপালে এই সময়টায় প্রচুর
তুষারপাতের কারণে পাখিরা বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে। দূর-দূরান্ত
থেকে আসা নাম না জানা এসব পাখিকে স্বাগত জানায় জাবি ক্যাম্পাস। শীত চলে গেলে তারাও
চলে যায় তাদের আপন ঠিকানায়। তাই এসব অতিথিকে স্বাগত জানাতে নতুনরূপে সেজেছে লেকগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় ১০ থেকে ১২টি লেক থাকলেও পাখি আসে মূলত চারটি লেকে। এ বছর এখন পর্যন্ত রেজিস্ট্রার ভবনের সামনের লেক ও ট্রান্সপোর্ট সংলগ্ন লেকেই দেশীয় সরালি নামের হাঁসজাতীয় পাখির দেখা মিলেছে। বাকি লেকগুলোতে এখনো পাখি আসতে শুরু করেনি। এছাড়াও ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশের লেকেও দেখতে পাবেন খুনসুটিতে ব্যস্ত অতিথি পাখিদেরকে। জাবির এই আঙিনায় অতিথি পাখিদের মধ্যে অন্যতম হলো, সরাল, পিচার্ড, গার্গেনি, মুরগ্যাধি, মানিকজোড়, কলাই, নাকতা, জলপিপি, ফ্লাইপেচার, কোম্বডাক, পাতারি, চিতাটুপি, লাল গুড়গুটি ইত্যাদি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রাণীবিদ্যা বিভাগের তথ্যমতে,
১৯৮৬ সালে সর্বপ্রথম এখানে অতিথি পাখি আসে। তখন ক্যাম্পাসে ৯৮ প্রজাতির
পাখি দেখা যেত। বর্তমানে ১৯৫ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এর মধ্যে ১২৬টি দেশীয়
প্রজাতির এবং ৬৯টি বিদেশি। এদের বেশির ভাগই হাঁস জাতীয় পাখি। এ ক্যাম্পাসে যে সব
পাখি আসে সেসবের মধ্যে ৯৮ শতাংশই ছোট সরালি। আর বাকি ২ শতাংশ অন্য প্রজাতির পাখি।
প্রাণিবিদ্যা
বিভাগের অধ্যাপক ও পাখি গবেষক মো. কামরুল ইসলামের মতে, এই ক্যাম্পাস পাখিদের
জন্য সবচেয়ে ভালো অবাসস্থল। এই আবাসস্থল টিকিয়ে রাখতে প্রতি বছর পাখি মেলার আয়োজন
করাসহ নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু ক্যাম্পাসের পরিবেশ বিপর্যয়, খাদ্য সংকট সহ দর্শনার্থীদের অসচেতনাতাকে বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন এই
গবেষক। আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভবিষ্যতে পাখির আবাস্থল হিসেবে জাবির টিকে থাকা নিয়ে।
দৃষ্টিনন্দন লেকে নানা জাতের শাপলা আর তার মাঝে অতিথি পাখির বাহারি রূপের খুনসুটি দেখতে আপনিও আসতে পারেন আর হারিয়ে যেতে পারেন কিছুক্ষণের জন্য। ক্যাম্পাসে পাখি দেখার সবচেয়ে ভালো সময় শীতের সকাল ও বিকেলবেলা। তাই খুব সকালে গিয়ে সারা দিন কাটাতে পারেন ক্যাম্পাসে। দুপুরে খেয়ে নিতে পারেন ক্যাম্পাসের বটতলাখ্যাত বিভিন্ন খাবারের দোকানে। আর উপভোগ করতে পারেন রক্তকমল শাপলা শোভিত লেকের মাঝে অতিথি পাখির এক অনন্য প্রকৃতির ছোঁয়া।
কিভাবে যাবেন-
ঢাকার গুলিস্তান, ফার্মগেট, কল্যাণপুর কিংবা গাবতলী থেকে নবীনগর, মানিকগঞ্জগামী যেকোনো বাসে চড়ে সহজেই নেমে যেতে পারবেন ক্যাম্পাসের সামনে। বাসে ভাড়া পড়বে ৩৫ থেকে ৬০ টাকা। ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার জন্য সহজ বাহন আছে তিন চাকার ভ্যানগাড়ি কিংবা রিকশা।