স্বাস্থ্য–পর্যটনে উন্নতি করছে মালয়েশিয়া
Tweet
হাসপাতালে ঢুকে কি
ওষুধ বা অন্য কোনো গন্ধ আপনারা পেয়েছেন?
এ প্রশ্ন বিশ্বের ১০টি দেশের সাংবাদিকের প্রতি ছিল মালয়েশিয়ার
বেসরকারি প্রিন্স কোর্ট মেডিকেল সেন্টারের পরিচালক ভিনসেন্ট ওয়ানের।
এ প্রশ্নের কারণ হলো হাসপাতালটির আধুনিক সুযোগ-সুবিধা আর স্বাস্থ্যসেবার মানের কারণে। আমরা যখন হাসপাতালে ঢুকি, আসলেই মনে হয়নি এটি একটি হাসপাতাল। কারণ, ঢোকার পরই চোখে পড়ে একটি জায়গায় কিছু বই রাখা, পাশেই ফুলের তোড়া (বিক্রির জন্য), নবজাতকের জন্য তুলতুলে পোশাকও সাজিয়ে রাখা। আর একটু ভেতরে ঢুকলে দেখা মিলবে হাসপাতালের অভ্যর্থনাকেন্দ্রের। তারপর আছে কফি শফ। আর পুরো হাসপাতাল দেখার পরে ভিনসেন্ট ওয়ানের এ প্রশ্নের আসল মাজেজাও বুঝেছেন সাংবাদিকেরা। আসলে এ কথা তিনি বলতেই পারেন। কারণ, ২০১৭ সালে হাসপাতালটি ইউরোপের জরিপে সেরা ১০-এ ছিল। দিন দিন স্বাস্থ্যসেবায় ভালো করার ফল এই অর্জন।
মালয়েশিয়ার বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় সেবাগ্রহণকারীদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা দিচ্ছে মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিল (এমএইচটিসি)। মালয়েশিয়ায় স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে ধারণা দিতে এমএইচটিসি বিশ্বের কয়েকটি দেশের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কুয়ালালামপুরে।
এ সফরে দেশটি
সাংবাদিকদের জানিয়েছে, সরকারি-বেসরকারি দুই শতাধিক হাসপাতাল কম খরচে উন্নত চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এসব হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে তাঁর পরিবারের থাকা-খাওয়ার যাবতীয়
সুব্যবস্থাও আছে। কোথাও কোথাও আছে পাঁচ তারকা হোটেলের সুবিধা।
দেশটির গ্লিনেগেলস
কুয়ালালামপুর হসপিটাল, প্রিন্স কোর্ট মেডিকেল সেন্টার, কেপিজে আমপাং
পুত্রেই, কেপিজে দামানসারা হাসপাতাল ও বেভারলি উইলশায়ার ঘুরে
দেখিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা। হেলথকেয়ার ট্রাভেলের মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়া বিশ্বকে
জানাতে চায়, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য ‘এশিয়ার ইউরোপ’-খ্যাত দেশে আসুন।
কেপিজে আমপাং পুত্রেই হাসপাতাল
কেপিজে গ্রুপের কয়েকটি হাসপাতাল আছে মালয়েশিয়ায়। রাজধানী কুয়ালালামপুরেই আছে বেশ কয়েকটি। কুয়ালালামপুরের কেপিজে আমপাং পুত্রেই হাসপাতালটি সাধারণ চিকিৎসার জন্য ভালো। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হেলথ স্ক্রিনিং ব্যবস্থা। এখানকার চিকিৎসা খরচ নাগালের মধ্যে।
বাংলাদেশেও
চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ত আছে কেপিজে গ্রুপের হাসপাতাল। ওই হাসপাতাল হলো গাজীপুরের
কাশিমপুর তেঁতুইবাড়িতে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত
হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ।
প্রিন্স কোর্ট মেডিকেল সেন্টার
আধুনিক চিকিৎসার জন্য এটিকে এশিয়ার অন্যতম সেরা হাসপাতাল বলে মনে করেন অনেকে। বিলাসবহুল এই হাসপাতালে হৃদ্রোগ, ক্যানসার, মেরুদণ্ড, মস্তিষ্কসহ জটিল রোগ, হাড়গোড় ভাঙা, হার্ট বাইপাস, ভাল্ভ, হাঁটু প্রতিস্থাপনসহ চিকিৎসার সর্বশেষ প্রযুক্তির সব কটিই আছে। পাঁচ তারকা মানের এই হাসপাতাল চিকিৎসামানের কারণে পেয়েছে ইউরোপের বেশ কয়েকটি পুরস্কার। হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ বেশি হলেও এখানকার পরিবেশ ও যত্নের নমুনা দেখলে তা মানানসই বলেই মনে হয়েছে।
গ্লিনেগেলস কুয়ালালামপুর হসপিটাল
কুয়ালালামপুরের অন্যতম একটি হাসপাতাল। ক্যানসার, মেরুদণ্ড, মস্তিষ্কসহ নানা রোগের চিকিৎসার এ হাসপাতাল পরিচিত।
বেভারলি উইলশায়ার
কুয়ালালামপুরের এই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি মূলত ছোট ছোট সার্জারি করে থাকে। এখানে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট, কসমেটিক সার্জারি, ত্বকের বয়সের ছাপ রোধ ও দাঁতের সমস্যার সমাধান মেলে। এখানে বিশ্বমানের চিকিৎসা মেলে।
ব্যয় কম
দেশের বাইরে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া মানুষ চাইছেন কোথাও বেড়াতে গিয়ে স্বাস্থ্যটা পরীক্ষা করিয়ে নিতে। সঙ্গে পরিবারের জন্য কেনাকাটা হলেও মন্দ হয় না। রোগীর সঙ্গীদের জন্যও প্রয়োজন বিনোদনের। আর এসব সুবিধা থাকায় মালয়েশিয়া হয়ে উঠছে ভ্রমণপ্রেমী স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের অন্যতম গন্তব্য। আর হালাল পর্যটন সুবিধার কারণে মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য–পর্যটন দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এমএইচটিসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় মালয়েশিয়ার চিকিৎসা ব্যয় কম। সিএবিজি বা হার্ট বাইপাসে মালয়েশিয়ার খরচ ২০ হাজার ৮০০ ইউএস ডলার, যেখানে সিঙ্গাপুরে ৫৪ হাজার ৫০০ ডলার ব্যয় হয় একই চিকিৎসার জন্য। অন্যদিকে, এ চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে ৩৩ হাজার এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যয় হয় ২৯ হাজার ডলার। ভাল্ভ, হাঁটু প্রতিস্থাপনের চিকিৎসা ব্যয়ও মালয়েশিয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় কম। মাহাথির মোহাম্মদের দেশে লাগবে ১৫ হাজার, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩৮ হাজার, থাইল্যান্ডে ১৯ হাজার আর সিঙ্গাপুরে ৪৬ হাজার ডলার। এ ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসার ব্যয়ও অন্য অনেক দেশের চেয়ে কম। আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবি নিতে আগ্রহী ব্যক্তিদেরও কম খরচ পড়বে মালয়েশিয়ায়। ওষুধ ছাড়া আইভিএফের একটি সাইকেলে সেখানে খরচ পড়বে ৪ হাজার ২০০ ডলার। থাইল্যান্ডে ৪ হাজার আর সিঙ্গাপুরে ৯ হাজার ৪৫০ ডলার।
পেশেন্ট বিয়ন্ড বর্ডার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপেও মালয়েশিয়ার কথার সত্যতা মেলে।
সাম্প্রতিক সময়ে
আমেরিকাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল লিভিং স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী মালয়েশিয়া
স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বে সেরা দেশের তকমা পেয়েছে। এই অর্জনের পাশাপাশি
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল ট্রাভেল জার্নালের জরিপে ২০১৫ থেকে ২০১৭
সাল পর্যন্ত ‘চিকিৎসাসেবার গন্তব্য’ শীর্ষক তকমাও পেয়েছে
মালয়েশিয়া। মানসম্মত চিকিৎসাসেবা, সবার চিকিৎসার সুযোগ ও কম খরচের
কারণেই মালয়েশিয়া এসব অর্জন করেছে বলে অনুষ্ঠানে জানান দেশটির এমএইচটিসির প্রধান
নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেরিনা আজিল।
স্বাস্থ্য–পর্যটনে উন্নতি করছে মালয়েশিয়া
২০২০ সালে স্বাস্থ্যসেবায় ১০ বিলিয়ন মালয়েশীয় রিঙ্গিত আয়ের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে দেশটি। পর্যটনের জন্য মালয়েশিয়ার সুনাম অনেক আগে থেকেই রয়েছে। দেশটিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকেই বেড়াতে যান। বেড়ানোর পাশাপাশি কেউ কেউ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছেন। ফলে, মালয়েশিয়ায় স্বাস্থ্য–পর্যটন দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।
এমএইচটিসি জানিয়েছে, ১০ বছর ধরে মালয়েশিয়া সরকার স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। মালয়েশিয়ার চিকিৎসা এখন বিশ্বমানের। কোনো ক্ষেত্রে এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে কম। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে অনেকেই মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন চিকিৎসাসেবা নিতে।
সিইও সেরিনা আজিল
জানান, গত
পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা নিতে মালয়েশিয়ার হাসপাতালগুলোয় রোগীর সংখ্যা
বেড়েছে। সিঙ্গাপুর, ব্যাংককের তুলনায় মালয়েশিয়ায় চিকিৎসা
ব্যয় তিন ভাগের এক ভাগ বলে দাবি করেন তিনি। বিমানবন্দরে রোগীদের যোগাযোগের
সুবিধার্থে বিশ্বের নানা ভাষার অনুবাদক সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকেন। আর কোনো
হাসপাতাল যদি স্বাস্থ্যসেবার ব্যত্যয় ঘটায়, তাদের ওপর খড়্গ
নামে বলে জানান তিনি।
সেরিনা আজিল বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। অনেকেই সেকেন্ড হোম হিসেবে
মালয়েশিয়ায় আছেন। এখানকার রান্না-খাওয়াদাওয়া সবকিছুই হালাল। কাজেই মুসলিম দেশ
হিসেবে মালয়েশিয়াকে নিজের দেশের মতোই মনে করতে পারেন বাংলাদেশি রোগীরা। বাংলাদেশে
আমাদের এজেন্সির মাধ্যমে সহজেই রোগীরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ও ভিসা করাতে পারবেন। আমরা
বিমানবন্দরে রোগীদের জন্য আলাদা লাউঞ্জ রেখেছি। চিকিৎসার জন্য আসা পর্যটকেরা
বিমানবন্দরে পৌঁছালেই সেখানে তাঁদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। হাসপাতালে পৌঁছানো থেকে
শুরু করে বাকি কাজটুকু এমএইচটিসি করে দেয়। সরকারের নির্দেশ মেনে চলতে হয়
হাসপাতালগুলোকে। রোগীর কাছ থেকে কত টাকা ফি নেওয়া হবে, তাও
সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।’
মালয়েশিয়ায় হেলথকেয়ার ট্রাভেল শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। ২০১৮ সালে ১২ লাখ সেবাগ্রহীতা চিকিৎসার জন্য মালয়েশিয়া এসেছেন। এর জন্য দেশটির কোষাগারে জমা হচ্ছে অর্থ। গত বছর সেবা দিয়ে শুধু হাসপাতালগুলো ১৫ লাখ রিঙ্গিত (মালয়েশিয়ার মুদ্রা) অর্জন করেছে। আর পুরো অর্থনীতিতে এর অবদান কয়েক শ কোটি রিঙ্গিত। ২০২০ সালের মধ্যে দেশটির এ খাতের অর্থনীতিতে আয়ের লক্ষ্য ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন রিঙ্গিত। গত বছর স্বাস্থ্য খাতে ১৫ হাজার চাকরি হয়েছে বলেও জানান সেরিনা আজিল।
এমএইচটিসি মালয়েশিয়ার হাসপাতালগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিত্সাপ্রত্যাশীদের যোগাযোগে কাজ করছে। বাংলাদেশে এমএইচটিসির স্থানীয় সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছে গ্রিন ডেলটা ইনস্যুরেন্সের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান জিডি অ্যাসিস্ট লিমিটেড। তারা বাংলাদেশি রোগীদের পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে আসছে। প্রাথমিক পরামর্শ, চিকিৎসক বা হাসপাতাল নির্বাচন, যোগাযোগসহ মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাপ্রত্যাশী বাংলাদেশিদের স্বাস্থ্যবিমার সুবিধাও দিচ্ছে জিডি অ্যাসিস্ট।
মালয়েশিয়ার প্রায় সব কটি বড় হাসপাতালে বিদেশি রোগীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। বিদেশিদের সব ধরনের সহায়তা করতে আছে এমএইচটিসি। কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আছে এমএইচটিসি লাউঞ্জ। বিমানবন্দর থেকেই বিদেশি চিকিৎসাপ্রার্থীরা বিভিন্ন সুবিধা পেতে পারেন। মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত ওয়েব ঠিকানা https:www.mhtc.org.my