একজন জ্যোৎস্না ছড়ানো মেঘে ঢাকা চাঁদের গল্প
Tweet
পর্যটন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘পর্যটনিয়া’ পর্যটন শিল্পের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে আসছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যটন বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করছে এমন অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথাযথ তথ্যের অভাবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত। সুতরাং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পর্যটনের সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ প্রকাশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যটনিয়া। পর্যটন বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করার পর তাঁদের আজকের অবস্থান একজন ছাত্রকে হয়তো তার নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়তে স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহসী করে তুলবে। পর্যটনের সফল উদ্যোক্তা ও সাবেক ছাত্রদের ‘ক্যারিয়ার স্টোরি’ হোক শঙ্কিত ছাত্রদের দিকনির্দেশনা আর সাহসী ছাত্রদের প্রেরণা। আমাদের এই পর্বের আয়োজন জনাব কিশোর রায়হানকে নিয়ে। যিনি লেখায় ও কর্মে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে। পর্যটন বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করছে এমন ছাত্র-ছাত্রী ও নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য তিনি একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বটে।
কিশোর রায়হানের জন্ম নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায়, শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষার কিছুটা সময় চট্টগ্রামে কাটলেও মূলত নিজ গ্রামেই বেড়ে উঠা। হাতিয়া থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকায় এসে ব্যবস্থাপনায় অনার্স পড়েন। তারপর থেকেই পর্যটনে জড়িয়ে যাওয়ার গল্প শুরু। গল্পটা অম্লমধুর। লক্ষ্য বহুদূর, হতে হবে ভালো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পিতা ছিলেন বাংলাদেশ নেভীতে কর্মরত, পরবর্তীতে তিনি সরকারি আইডি নিয়ে ফরেন শীপে যোগদান করেন। সরকারি চাকরিজীবী বাবা ও গৃহিণী মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি পঞ্চম।
আজকের তরুণ সফল পর্যটন উদ্যোক্তা কিশোর রায়হান ছোটো বেলায় মনের গহীনে লালন করতেন ডিটেকটিভ হওয়ার সুপ্ত বাসনা, কিন্তু মা চাইতেন তিনি হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর বাবা ভাবতেন মেরিনার। এগুলোর কোনটাই না হয়ে ব্যবস্থাপনায় অনার্স করার পর ভাবলেন গতানুগতিকতার বাইরে করতে হবে পদচারণ। এরই মধ্যে একদিন তার বড়ভাই ক্যপ্টেন মোহাম্মদ শামীম পত্রিকায় ন্যাশনাল হোটেল এন্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’র একটি ভর্তি বিজ্ঞাপন দেখিয়ে তাকে কোর্সটির জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। পরিবারের সবার সম্মতিতে সেই কোর্সে ভর্তি হওয়ার মধ্যে দিয়ে তার ভাগ্যাকাশে শুভসূচনা হয়ে গেল পর্যটন প্রেমী ও এক্সপ্লোরার হয়ে ওঠা গল্পের। বাবার ডজন পাঁচেক দেশ ভ্রমণের ইতিহাস থেকেই অবশ্য পর্যটন প্রেম জন্ম নেয় তার মনের মধ্যে। কিন্তু বড়ভাইয়ের দেখানো বিজ্ঞাপনটাই তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। গল্পে গল্পে বড়ভাইয়ের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্ট বিভাগ থেকে পড়ালেখা শেষে ক্যারিয়ারের শুরুতে একসাথে দুটো চাকরির অফার আসে। শুধুমাত্র কাজ শেখার সুযোগের সুবিধায় অন্যটার চেয়ে অর্ধেক বেতনে আরেকটাতে যোগদান করেন। ন্যাশনাল হোটেল এন্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এর শিক্ষকদের পরামর্শ ছিল ক্যারিয়ারের শুরুতে বেতনের চেয়ে ব্যবহারিক কাজ শেখাকেই গুরুত্ব দিতে হবে। সেই পরামর্শ মাথায় নিয়ে তিনি পর্যটন বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের জন্য পেশাগত নিয়মিত কাজের পরে পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা রকম কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়াতে শুরু করলেন। বিভিন্ন ধরনের পর্যটন মেলা, সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি একটু অবসর পেলেই কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে পরতেন। এদিকে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই এক্সিকিউটিভ থেকে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার পদ পর্যন্ত উঠে আসেন। তবে ন্যায্য কিছু দাবী পূরণ না হওয়ায় তিনি একদিন চাকরিটা ছেড়ে দেন অভিমান করে। পরে প্রতিষ্ঠান মালিক তাকে ডেকে নিয়ে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পদের প্রস্তাব দিলেও তিনি কোম্পানিতে পুনরায় ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
কয়েকমাস পরে তিনি সায়েদ গ্রুপে সিইও হিসেবে যোগদান করে গড়ে তোলেন সায়েদ আর. কে. ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস লিমিটেড। এরই মধ্য দুটি এয়ারলাইন্স থেকে টিকেটিং এন্ড রিজার্ভেশন ডিপার্টমেন্টে কাজের সুযোগ পেয়েও তিনি মগ্ন থাকেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত আর. কে. ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস লিমিটেডের বিজনেস ডেভেলপমেন্টে। ২০১৩ সালে অন্যান্য পরিচালকদের অসহযোগিতা ও মতপার্থক্যের কারণে নিজের শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে একক ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন পেরেন্টস এভিয়েশন। যা আজকের পেরেন্টস এভিয়েশন লিমিটেডে রূপ নিয়েছে, বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
পরিশ্রম, সততা আর শৃঙ্খলা দিয়ে জীবন গড়া কিশোর রায়হান একজন সফল উদ্যোক্তা ও সংগঠক। পেশাগত জীবনে এরমধ্যেই তিনি দেশ-বিদেশে দেড় শতাধিক গ্রুপ ট্যুর পরিচালনা করে উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আবার সংগঠক হিসেবে ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি শিল্পের পেশজীবী ও আগ্রহীদের নিয়ে পর্যটন বিষয়ে গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন “বাংলাদেশ স্কুল অফ ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি”।
একযুগের অভিজ্ঞতার আলোকে পর্যটনের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে আসছেন নিয়মিত। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বহু প্রশিক্ষণার্থীকে ইন্টার্নশিপ ও ট্যুরিজমের বিভিন্ন বিষয়ের উপরে প্রফেশনাল প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, যাদের অনেকেই বিভিন্ন এয়ারলাইনস, হোটেল, ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেশন ফার্মে কর্মরত আছেন। কেউ কেউ নিজেই ট্যুর গাইডিং, প্রশিক্ষক ও উদ্যোক্তা হিসেবে পর্যটন শিল্পে কাজ করছেন। তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় গত এক যুগে ১৩টি প্ৰতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যেগুলো সফলতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কিশোর রায়হানের হাত ধরে পর্যটন শিল্পে এখন পর্যন্ত পাঁচ থেকে ছয়শো মানুষের কর্মসস্থান হয়েছে।
ব্যাক্তিগত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়ে বরাবরই উদাসীন কিশোর রায়হানকে নিয়ে ২০১২ সালে আমার সংবাদ ও ২০১৭ সালে আমাদের সময় পত্রিকায় তরুণ ও সফল উদ্যোক্তা হিসেবে ফিচার প্রকাশিত হয়েছিলো। অবশ্য স্কুল জীবনেই তার লেখা কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতা, ছোট গল্প, নাটক, গান লেখার একটা ঝোঁক ছিল সেই সময়। কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই পথশিশুদের নিয়ে তার লেখা কয়েকটি নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালিকা ও ভাজপত্রেও স্থান পেয়েছিল বেশ কিছু গল্প ও কবিতা।
একজন কিশোর রায়হান সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ২০১২ সালে পথশিশুদের শিক্ষা, চিকিৎসা, খ্যাদ্য ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু সমমনা মানুষকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন “দি ডে ড্রিম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন”। প্রতিষ্ঠার ৩ বছরের মধ্যে ৪০-৪৫টি পথশিশু কে সার্বিক সেবা ও সহযোগিতা প্রদানও করেন। পরবর্তীতে পারিপার্শ্বিক নানা কারনে তা স্থগিত করতে হয়। তবে তিনি আশাবাদী যে, পথশিশুদের পাশে আবার দাঁড়াতে পারবেন শীঘ্রই।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং নারীদেরকেও ভ্রমণে উৎসাহিত করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘চল সই ডানা মেলি’ নামের একটি অনলাইন ট্রাভেল গ্রুপ। একজন দক্ষ নারী পরিচালকের তত্বাবধানে নারী গাইড দিয়েই সেসব ভ্রমণ পরিচালনা করে আসছেন সুনামের সাথে।
ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্ট বিভাগের ছাত্র থেকে একজন সফল পর্যটন উদ্যোক্তা, প্রশিক্ষক, প্রবন্ধ লেখক ও ট্রাভেল কনসালটেন্ট হিসেবে গড়ে উঠতে মা-বাবার পরে পরিবারের যে মানুষটি তাকে সবথেকে বেশি সাপোর্ট দিয়েছেন তিনি হলেন তার মেজো ভাই ডক্টর জামাল উদ্দিন। তিনি তার মেজো ভাইয়ের প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ব্যাক্তিগত জীবনে জনাব কিশোর রায়হান একটি পুত্র সন্তানের জনক। প্রিয় সহধর্মিণী মিসেস, রাহিনা সুচী যিনি ঢাকা বিশবিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এই দম্পতি প্রার্থনা করেন যেন তাদের আড়াই বছর বয়সী সন্তান রুহশান সামায়ান খান সুস্থ পৃথিবীতে একজন ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠে।
পর্যটন প্রেমী কিশোর রায়হান যেসকল সংঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি জড়িত-
পরিচালক অপারেশন – বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার’স এসোসিয়েশন।
পরিচালক – বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন। চেয়ারম্যান – দি ডে-ড্রিম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক- পেরেন্টস এভিয়েশন লিমিটেডে।
ম্যানেজিং পার্টনার – স্টাডি এব্রোড কনসালটেন্ট।
ট্রেজারার – ঢাকা পর্যটন সমবায় সমিতি লিমিটেড।
আজীবন সদস্য – ঢাকাস্থ হাতিয়া দ্বীপ সমিতি।
পরিচালক – ফেস্টিভ এন্ড কালচারাল ট্যুরিজম কনসোর্টিয়াম।
স্বত্বাধিকারী – চল সই ডানা মেলি ট্রাভেল গ্রুপ।
ব্যাক্তিগত চাওয়া-পাওয়ায় নিরপেক্ষ থাকা কিশোর রায়হান তৃপ্তি অন্বেষণ করেন কাজের মধ্যে। তিনি বিশ্বাস করেন, কি পেলাম আর কি পেলাম না সেটা মূখ্য নয়, রাষ্ট্র ও সমাজকে আমি কি দিতে পারলাম সেটাই মূখ্য। নিজের কাজ নিয়ে নিজে তৃপ্ত থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ তবে ভালো কাজের স্বীকৃতি পেলে উৎসাহ বাড়ে বলে তিনি মনে করেন।
পর্যটন পেশাজীবি, প্রশিক্ষক, প্রবন্ধ লেখক ও ট্রাভেল কনসালটেন্ট কিশোর রায়হান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পথ ছিল ঘাত-প্রতিঘাতে ভ’রা। সকল বাধাবিপত্তি কাটিয়ে সামনে চলার দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দেওয়ার গল্প অল্প কথায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মান উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছেন বিভিন্ন ভাবে। আমরা শুধু একজন পর্যটন উদ্যোক্তা ও ভ্রমণপ্রেমী মানুষ হিসেবে তার জীবনের কিছু গল্প তুলে ধরেছি। মহাকালের কাছে প্রায় একযুগ হয়তো তেমন বেশি কোনো সময় নয় কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ব্যাক্তিগতভাবে অতিক্রম করেছেন বহুপথ। এতোটা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তিনি দেশ-বিদেশের বহু জাতি, পেশা ও ধর্মের মানুষের সাথে কাজ করেছেন। সবার সাথে কাজ করতে গিয়ে কখনো সহযোগিতা পেয়েছেন আবার কখনো মুখোমুখি হয়েছেন দুঃসহ তিক্তত অভিজ্ঞতার। ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা এই পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পরেছেন বহুবার, কিন্তু ভেঙে পরার আগেই উঠে দাঁড়িয়েছেন আবার। লক্ষ্যে স্থির থেকে ধৈর্য্য ও একাগ্রতা নিয়ে তিনি শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে চলেছেন। দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে তার এই এগিয়ে চলা আরও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হোক পর্যটনিয়া পরিবার সেই কামনা করে।