সুধার পেছন পেছন পাহাড় পাড়ি
Tweet
২৮ জুন যখন নেপাল ত্রিভূবন এয়ারপোর্ট নামি তখন আকাশে খুব মেঘ। চারদিকে বৃষ্টির আনাগোনা। নামার আগে মিনিট দশেক সৃষ্টিকর্তাকে নিচে নামিয়ে আনার মোটামুটি একটা চেষ্টা প্লেনের প্রায় সব যাত্রীই করে ফেলেছিল। মেঘের সাথে অহেতুক একটা বাগড়া বারবার নাড়া দিচ্ছিল। ইমিগ্রেশানের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কিছুক্ষণ বাদেই রওনা দিই নাগরকোটের উদ্দেশ্যে।
কাঠমান্ডু থেকে খুব বেশী দূরে নয়। ঘণ্টা দুইয়ের রাস্তা। পথে যেতে যেতে পাহাড়গুলো দূর থেকে ডাকছিল। কাঁচ ভেঙে একটা অমায়িক ঘোর লাগা অনুভূতি বোধ করছিলাম। রাস্তায় মানুষ খুব হালকা। প্রাইভেট কার কিংবা বাসের চাইতে মোটর বাইকের আধিপত্য বেশী। মানুষের মধ্যে ব্যস্ততা কম। যেন একটা সঙ্গীতের আবহ রাস্তা জুড়ে। অলিগলি পাড় হয়ে নাগরকোটের রাস্তা ধরলাম। মনে হচ্ছিল পুরান ঢাকা পার হচ্ছি। ঘুপচি বাড়ি, মানুষের অবাধ্য চলন, পুরানো ধাচের বিল্ডিং..যেন আগামসি লেন। যখন হাই-ওয়েতে উঠলাম আমি আর কারো কথা শুনিনি। একমনে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। উঠছি আর উঠছি। আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো শুধু উপরের দিকে উঠছে। পাকুর, পাইন গাছের সারি পার হচ্ছি আর শ্বাস ভারী হচ্ছে। আমি গাড়ির কাঁচ গলে মেঘ ছুয়ে দেখছিলাম। নারীর বাঁকা কোমড় বেয়ে আমি শুধু উপরে উঠে যাচ্ছি যেন সুধার টানে…
আড়াই ঘণ্টার এক ভ্রমন শেষে পৌঁছলাম নাগরকোট হোটেলে। সেখানে সুর্যাস্ত দেখার কথা। আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে সুর্য আর দেখিনি। বরং মেঘের সাথে একদান লুডু খেললাম হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের চুমুক দিতে দিতে। রুমে জামা কাপড় রেখে নেমে পড়লাম লবিতে। তখন রাত প্রায় ৮টা। নামলাম। মনে হচ্ছিল পৌষ মাস। মা পাশের রান্নাঘরে ভাপা পিঠা করছে। আমি মুখ গোল করে ধোঁয়া ছাড়তে চাইলাম। হলো না। তবে ঠান্ডা বাতাসটা টের পাচ্ছিলাম। হোটেল ছেড়ে নামলাম শহর দেখতে। এক নেপালি ভদ্রলোক বললেন, “ইয়াহাপে কুচ নাহি হ্যাঁ। রাত মে বাহার ঘুমনা আচ্ছা নেহি হ্যাঁ। ওয়াপাস যাও।” অগত্যা ফিরলাম। রাতে হাল্কা কিছু খেয়ে ঘুমালাম সূর্যোদয় দেখব এই আশায়। রাত সাড়ে চারটায় উঠে বসে রইলাম। আমি মেঘের সাথে ৬-৭ দান লুডু খেলে তখন প্রায় সকাল সাড়ে সাত। নাস্তা করে বেরুলাম কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে। আবার সেই একই রাস্তা। শুধু এবার নারীর বাকানো কোমর বেয়ে নিচে নামার পালা অমায়িক সুধার আশায়…
বেলা বারটা নাগাদ পৌঁছলাম কাঠমান্ডু হোটেলে। একটু ফ্রেশ হয়ে নেমে পড়লাম রাস্তা দেখব, শহর দেখব এই আশায়। যেই এলাকায় ছিলাম ওটা কাঠমান্ডুর সবচাইতে বড় ট্যুরিস্ট প্লেস (থামেল)। ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর গেলাম। নানান বাহারী দোকানগুলো সাজিয়ে রেখেছে সব শাদা চামড়ার মানুষের কাছে বেচতে। কিছু জিনিস ধরতে গিয়েও ধরার সাহস পাইনি। খুনি দাম। বিকেল নাগাদ গাইড এসে নিয়ে গেলো শুম্ভুনাথ মন্দিরে। ঐ জায়গা থেকে পুরো কাঠমান্ডু একবারে দেখা যায়। পুরাকীর্তি গুলো বারবার চোখে পড়ার মতো। কয়েকটা ভেঙে গেছে ভূমিকম্পে, কয়েকটা এখনো আছে পর্বতের ন্যায়। এখানেও মানুষ নানান বাহারি তৈজসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছে। এ এক অনন্য অনুভূতি। পুরো শহরটাকে এক লহমায় দেখে নেয়া, এক বাক্সে বন্দি করা- দুর্লভ। বেরুলাম। সেখান থেকে গেলাম দরবার স্কয়ারে। এখানেও ভূমিকম্পের কড়াল থাবার চিহ্ন পাওয়া যায়। একটা চায়ের দোকানের জন্যে অস্থির ছিলাম। পেয়ে গেলাম। ভদ্দরলোক চা দিতে দিতে বললেন, বাঙালি? বললাম হ্যাঁ। বললেন, আমি কলকাতার। ওখানে স্কুল মাস্টার ছিলাম। এখন এখানে থাকি। ভালই লাগে। খুশি মনে পরপর দুই কাপ চা খেয়ে বেরুলাম দরবার স্কয়ার থেকে। হোটেলে পৌঁছে ডিনার। এরপর পোখারা যাওয়ার প্রস্তুতি….নারী ডাকছে অশ্লীল ভঙ্গিতে।
পোখারা। লোকমুখে শোনা এর অভিজ্ঞতা অসাধারণ। সকাল ৭টায় বাস। বাস স্ট্যান্ড পৌঁছলাম ছ’টা পয়ঁত্রিশ কি ছত্রিশে। ব্যাগ ঢুকিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। চায়ের কেতলিতে চা গরম করছেন এক মহিলা। চা খেলাম। গাইড বলল, আপতো কুচ খায়া নেহি। ফিরভি চায়ে পিরাহাহো? আমি হাসলাম। এর চাইতে ভালো জবাব আর নাই। বসলাম। জানালার পাশে। সাত ঘণ্টার সুধাযাত্রা। নগর ছেড়ে যখন পাহাড়ের রাস্তা ধরল তখন একটা ঘোর লাগলো। এটা কি দুনিয়া? এটা কি পৃথিবী? এখানে আমি বাস করি? এখানে আমরা পাপ করছি? এই সুন্দরের মাঝে? পাহাড়গুলো দৃপ্ত, অমায়িক, লাজুক আবার কখনো মিশ্র খুনি। একবার উপরে উঠছি তো আবার একবার নিচে। সুধা কোথায়? জিগজাগ রাস্তা, তিনবার বিরতি, পথে বিদেশি নারীকুলের অবাক চেহারা দেখতে দেখতে যখন পোখারা পৌঁছলাম তখন প্রায় ৩টা। আমার একটু অদ্ভুত লাগছিল। এ জায়গা এমন হতে পারে না। কাঠমান্ডু থেকে একেবারে আলাদা। মানুষ নেই। রাস্তা প্রশস্ত। অনেক বেশী সবুজ, অনেক বেশী বৃষ্টি, অনেক বেশী ভালোবাসা। হোটেল থেকে মাউন্ট এভারেস্ট দেখলাম। এটা স্বপ্ন থেকে বেশী কিছু। সন্ধ্যার পর লেকসাইড দিয়ে হেঁটে বেরুলাম। কিছু কিছু দোকানে ঘুরে দেখলাম। লেকসাইডে যখন দাঁড়িয়ে তখন ভাবছিলাম, ওকে নিয়ে আসলে বড় ভালো হতো। একা এ সৌন্দর্য দেখা পাপ। আরেকবার। সাথে আলবৎ ও থাকবে। রাতে হোটেলে ফিরলাম সুখবোধ নিয়ে। পরের দিন ভোর চারটায় উঠতে হবে- গন্তব্য সারাংকোট!
ভোর চারটায় যখন গাড়িতে উঠলাম তখন রাস্তায় আলো ফুটেনি। নিয়ন বাতির আলোতে হালকা হালকা কুয়াশা দেখা গেলো। আবারো পাহাড় বেয়ে উঠার পালা। সুধার আশায়। সুধা তুমি কই? মিনিট চল্লিশের এক রাইড এসে দাঁড় করালো একটা পাহাড়ের ঢালে। গাইড বলল, এই পাহাড় বেয়ে উপড়ে উঠে যান। ওখানে একটা দোচালা বাড়ি দেখবেন। সেখান উঠে যাবেন। গেলাম। দেখলাম অনেক বিদেশি পরিব্রাজক আগেই ক্যামেরা নিয়ে আসন গেড়ে বসে আছেন। আমি শুধু দেখলাম স্বপ্ন। একটা ভুল স্বপ্ন। আমার চারপাশে মেঘ। আমার চারপাশে পাহাড়। অদূরে মাউন্ট এভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, একটা স্বপ্ন। এক ঘণ্টা ঘোরে ছিলাম। আমি দেখছিলাম, আমি ভেসে বেড়াচ্ছি অন্নপূর্ণার গা বেয়ে। সাথে ও। চা করছে। ওর খুব ঠান্ডা লাগছে। কানটুপিটাও সাথে আনেনি। ও যে কি না! সারাংকোট থেকে ফিরতে ফিরতে আটটা। ঘণ্টা দুইয়ের বিরতির পর রওনা দিলাম দেভি’স ফল দেখতে। একে একে মহাদেবের মন্দির, শিব মন্দির, ব্যাটস কেইভ, ফেওয়া লেক দেখে ফিরলাম প্রায় সন্ধ্যায়। আমার ব্যাগে এক সমুদ্দুর স্বপ্ন, সারাংকোটের সুধা।
পরের দিন পোখারা ছাড়ি কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে। আমি পেছন ফিরে দেখছিলাম নেফারতিতি কি করে ভিজে যাচ্ছে, কি করে মেঘের কোলে ভেসে বেড়াচ্ছে আমার কবিতার পংক্তিগুলো। কাঠমান্ডুতে শহরকেন্দ্রিক একটা সভ্যতায় ফিরে এলাম। পুরো শহরটা আবার ঘুরলাম সেই বিকেলে। বাড়ির জন্য কিছু কিনলাম। পরেরদিন এই স্বপ্নের শেষ। যবনিকা টানবে গল্প। পর্দা নামবে সুধার পিছে নিছক দৌড়ের এক নির্জীব নাটকের।
৩ জুলাই। আমি ফিরি পাহাড়কন্যাকে পিছনে ফেলে। আমার নীল ব্যাগ জুড়ে থাকে পোখারা, সারাংকোট আর নাগরকোটের মেঘ, সুধা পানের লোভাতুর কামনা, স্বপ্নের ইতি টানি আবার মেঘের কোলে চড়ে। তোমায় আমি মিস করবো, নেপাল।
পাহাড়কন্যা, বিদায়।
সুধা কি পেলাম? আদতে…হ্যাঁ!
স্মৃতির পাতা থেকে লিখেছেন নিশাত হোসেন