বঙ্গবন্ধু ও পর্যটনের প্রসারিত সময়রেখা
Tweet
মোখলেছুর রহমান– মুজিবর্ষের ১৫ আগস্ট ২০২০ বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রচনা করা হলো।
উপক্রমণিকা:
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে পৃথিবীতে আজকের মতো পর্যটন জেকে বসে নাই। তাই এর ভালোমন্দ, বিকাশ, বিনিয়োগ ইত্যাদি নিয়ে গুটি কয়েক দেশ ছাড়া আমাদের মতো যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের ভাববার কোন অবকাশ ছিলো না। এমনকি জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার জন্মও হয় নাই তখন পর্যন্ত। বাস্তবিক অর্থে গত শতকের শেষ দশক থেকে পর্যটন পৃথিবীর সকলের কাছে দৃশ্যমান হতে শুরু করে এবং মাত্র ৩ দশকের মধ্যে তা পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম শিল্পখাতে পরিণত হয়ে যায়। এই বিকাশ ও বিস্তার অদৃশ্যপূর্ব। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন স্থাপনের মাধ্যমে এদেশে পর্যটন বীজ বপন করে দিয়ে যান। তাঁর এই দূরদর্শিতাকে শ্রদ্ধা জানাই।
পর্যটনের মৌলিকতা:
পর্যটনকে এখন জীবনমুখী কর্মকান্ডের যোগফল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর অর্থ হলো জীবন পরিচালনার জন্য সকল কাজই পর্যটন, জীবনের সকল উপাদানই পর্যটনের উপাদান। জীবনের উপাদান ও পর্যটনের উপাদানগুলি সমার্থক হয়ে গেছে আধুনিক পর্যটনের কাছে। পর্যটন এখন আর বিশ্রাম, বিনোদন ও হলিডে কাটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। এর উচ্চতর প্রয়োগ ও অবদান সমাজের সর্বস্তরে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এতোসব ক্রমাগত উন্নয়ন আমাদের মধ্যে একটি পর্যটনবান্ধব রাষ্ট্রের ধারণাও তৈরি করছে। পর্যটন প্রতিভাত হচ্ছে উন্নয়নের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু, পরিকল্পনার ভিত্তি এবং জীবনের দর্শন হিসেবে।
হাল আমলের পর্যটন:
পর্যটন এখন কেবলই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যম নয়, নতুন জীবনশৈলী। পর্যটন একসাথে বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য, সমাজ বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের বিষয় হিসেবে নিজের স্থান দখল করে নিয়েছে। পর্যটন তার অন্যান্য অবদানের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক বাস্তু রক্ষায় অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে গৃহিত হচ্ছে। উচ্চতর বিদ্যাপিঠগুলি এর উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছে। এর অর্থ হলো এই যে, পর্যটন এখন মানুষের জীবনের গভীরে মননশীলতা নিয়ে প্রবেশ করেছে এবং শিক্ষা ও গবেষণায় আর সমাজ গঠন ও শান্তি স্থাপনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে পর্যটনের সূচনা:
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান পর্যটন উন্নয়ন কর্পোরেশন লিমিটেড বিলুপ্ত করে ১৯৭২ সালের ২৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১৪৩ দ্বারা দেশের প্রথম সরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন’ যাত্রা শুরু করে। জাতির জনকের এই সিদ্ধান্ত ছিল সময়োপযোগী ও সুদূর প্রসারী। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বিপর্যস্ত রাষ্ট্রে এহেন সিদ্ধান্ত আমাদের পর্যটনের বেড়ে উঠার পক্ষে ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পর্যটনকে দরিদ্র রাষ্ট্রে ব্যবসায় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার। তাই ১ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধন এবং ৫ লক্ষ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে এই কর্পোরেট গঠন করা হয়। সরকার পরিশোধিত মূলধন সরবরাহ করে। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নিয়ে অভ্যন্তরীণ পর্যটন গড়ে তোলা এবং আন্তর্জাতিক পর্যটনে অংশগ্রহণ ও পর্যটনভিত্তিক গবেষণা করা ছিলো এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কাজ।
প্রসারিত সময়রেখার বিশ্লেষণ:
মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে তিনি বিধ্বস্ত বাংলাদেশে একটি রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণে মনযোগী হন। আমরা আজকের দিনে জানি যে, সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডই পর্যটনের উন্নয়নকে প্রশস্ত করে। তাই তাঁর আমলের সকল কর্মকান্ডকে প্রসারিত একটি সময়রেখায় ফেললে তা আজকের পর্যটনে কী প্রভাব বিস্তার করে সে বিষয়ে একটি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। তাই তাঁর শাসনামলের কতিপয় বিষয় ও বিশ্লেষণ এখানে উপস্থাপন করা হলো:
ক) বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সমর্পণের আহ্বান জানান। তার দূরদর্শী রাজনৈতিক পদক্ষেপের জন্য ১২ মার্চ ১৯৭২ তারিখে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে। মুক্তি বাহিনীর জওয়ানদের কাজে লাগানোর জন্য বঙ্গবন্ধু ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী, মিলিশিয়া, রিজার্ভ বাহিনী সংগঠনের বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া দেশ গড়ার বিভিন্ন কাজে যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ প্রদান করেন। এই ব্যবস্থাকে পর্যটনে প্রয়োগ করলে আমরা গড়ে তুলতে পারতাম ‘মুক্তিযুদ্ধ পর্যটন’। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা, কাহিনী, স্মৃতিস্তম্ভ, বধ্যভূমি ও মুক্তিযোদ্ধা এইসব হতে পারে মুক্তিযুদ্ধ পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
খ) রিলিফ ও পুনর্বাসনের জন্য বঙ্গবন্ধু দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসংখ্যার ভিত্তিতে মঞ্জুরি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। দেশে নানা ধরণের প্রাকৃতিক জন্য এখনো রিলিফ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হয়। বিশেষত উপকূলীয় এলাকায় নিয়মিতভাবে প্রবাহিত ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রচুর আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও তা থেকে মানুষকে রক্ষা করা কৌশলকে কেন্দ্র করে এদেশে গড়ে তোলা যায় ‘রিয়েলিটি ট্যুরিজম’। ভৌগলিকভাবে অবস্থিত এই ব-দ্বীপের জন্য এই ধরণের পর্যটনকে গড়ে তোলার প্রচুর সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।
গ) বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এদেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সূচনা করেন। তাঁর এই দূরদর্শী রাজনৈতিক পদক্ষেপ বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে। গণতন্ত্রের এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে এদেশে রাজনৈতিক হানাহানি, অশান্তি, দলী ভাঙ্গা ইত্যাদি ঘটতো না। তাতে করে এখানে একটি সুস্থ্য রাজনৈতিক ধারা ও সুশাসন প্রবর্তিত হতো। ফলে বাংলাদেশ হয়ে উঠতো পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য, যা সহজেই পর্যটকরা গর্বভরে নিজেদের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিতে পারতো।
ঘ) বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর দারিদ্র্যপীড়িত জনগণের দ্রারিদ্র্য দূরীকরণ তথা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে জাতির পিতা প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসৃজন, জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং তার সুষম বণ্টন ইত্যাদি বাস্তবায়ন করাই ছিল মূল লক্ষ্য। একই সাথে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষির প্রযুক্তিগত রূপান্তর সাধন, খাদ্যশস্যের উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং শ্রমশক্তির শহরমুখী অভিবাসন বন্ধ করা এই পরিকল্পনায় প্রাধান্য পায়। উল্লেখ্য যে, আধুনিক পর্যটন এই সকল কার্যক্রমের সাথে থেকে অর্থনৈতিক প্রত্যেকটি বিষয়কে ত্বরান্বিত করে। বঙ্গবন্ধুর প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কেবল পর্যটনকে যুক্ত করলেই এটি পর্যটন উন্নয়নের এক ভিন্ন মাত্রা লাভ করতে পারে। তাঁর এই স্কুল অব থটকে কেন্দ্র করে আমরা গড়ে তুলতে পারি ‘কৃষি পর্যটন’, ‘কমিউনিটিভিত্তিক পর্যটন’এবং ‘জীবনযাত্রা পর্যটন’। আমাদের এই দেশে যে বৈচিত্র্য রয়েছে তা পর্যটনের বহুমুখিতার জন্য অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়।
ঙ) বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতি ছিলো সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরী মনোভাব নয়। প্রথম তিন মাসের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ৬৩টি দেশের স্বীকৃতি লাভ। ৩ মাস ২১ দিনের মধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় দুই বছর দুই মাসের মধ্যে। সর্বমোট ১২১টি দেশ স্বীকৃতি প্রদান করে। আজকের পৃথিবীতে পররাষ্ট্রনীতির বহুমুখিতা এসেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি সদা প্রযোজ্য। তার সাথে পর্যটন কুটনীতি যুক্ত করেই আমরা তৈরি করতে পারি সকল রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ইনবাউন্ড পর্যটন ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধুর উদারনৈতিক চেতনা সমৃদ্ধ দেশপ্রেমকে মাথায় রেখে কুটনৈতিকভাবে তা পর্যটনে তা প্রয়োগ করা একান্ত প্রয়োজন।
চ) ইসলামের যথার্থ শিক্ষা ও মর্মবাণী সঠিকভাবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচার-প্রসারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং ইসলাম আদর্শের যথাযথ প্রকাশ তথা ইসলামের উদার মানবতাবাদী চেতনা বিকাশের লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন। আমরা জানি যে, বিশ্ব ইজতেমা পৃথিবীতে মুসলমানদের ২য় বৃহত্তম ধর্মীয় জমায়েত। তাই সৌদি আরবের অনুকরণে একে ব্যাপকভাবে পর্যটনে কাজে লাগানো যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশে রয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নানান ধর্মীয় স্থান ভ্রমণ ও আচারাদি পালনের রীতি। বৌদ্ধদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিহারও রয়েছে এই দেশে। তাই বঙ্গবন্ধুর ধর্মীয় চেতনার মূল ভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে এখানে গড়ে তোলা যায় ধর্মীয় পর্যটনের বিশাল ক্যানভাস। উল্লেখ্য যে, বিশ্বপর্যটকদের মধ্যে ৭০% ই ধর্মীয় পর্যটক।
ছ) যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডার’ জারি করে।
পরবর্তীকালে একই বছরে এই আইন দুই দফা সংশোধন করা হয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে নেই, তাদের ক্ষমা করা হয়। কিন্তু যারা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যা—এই চারটি অপরাধ করেছে, তাদের ক্ষমা করা হয়নি। ১৯৭৩ সালে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে দালাল আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে অক্টোবর পর্যন্ত দুই হাজার ৮১৮টি মামলার সিদ্ধান্ত হয়। উপরন্তু বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৩ সালের ১৯ জুলাই ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট’ জারি করেন, যা পরবর্তী সময়ে আইন হিসেবে সংবিধানে সংযোজিত হয় এবং অদ্যাবধি তা বহাল রয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৮ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সংবিধানের ৬৬ ও ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তথাকথিত ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভোটাধিকার ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল করা হয়েছিল। একইভাবে ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে জাতির ভবিষ্যত তমসায় ছেয়ে যাবে। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাচালানি, মজুদদারি, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের ‘সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় এই কঠোরতা রাষ্ট্রকে বাসযোগ্য করে তোলে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। নাগরিকগণ আনন্দের সাথে বাস করেন। এই ধারা ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার, ন্যায্যতা ও সামাজিক ন্যায়পরায়নতা প্রতিষ্ঠিত হতো। তাতে দেশটি অনেক আগেই নাগরিকদের বাসযোগ্য হতো। পর্যটন বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, যে দেশ তার নাগরিকদের জন্য যতটা বাসযোগ্য, পর্যটকদের জন্য ততটা পছন্দের গন্তব্য। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে চলতে পারলে আজ বাংলাদেশ হতো অনেক দেশের নাগরিকদের জন্য পছন্দের একটি গন্তব্য।
জ) ১৯৭২ সালে সৌদি আরবে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে ছয় সহস্রাধিক বাংলাদেশি মুসলমানকে হজ পালনে প্রেরণ করা হয়। যদিও সৌদি আরব তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নাই। হজ এবং ওমরাহ এখন আমাদের জন্য অন্যতম ধর্মীয় পর্যটন। বঙ্গবন্ধু সেদিন শুরু করে দিয়ে গেছেন বলে আজ লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী ধর্মপ্রাণ ও বিত্তবান মুসলমান মক্কায় পবিত্র হজ ও ওমরাহর পালন করেন। আর একে কেন্দ্র করে বহু ব্যবসায়ী ও হজ অপারেটর ব্যবসায়ও করেন ।
ঝ) বঙ্গবন্ধু কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিলো সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি ও জীবনমুখী শিক্ষাদানের মাধ্যমে এদেশের মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলা। এই শিক্ষা ব্যবস্থা ধরে রাখতে পারলে আজকের বাংলাদেশের শিক্ষার চেহারা নিশ্চয়ই উন্নত হতো। শুধু তাই নয় বিদেশ থেকে পড়ালেখা করার জন্য আমরা অনেক শিক্ষার্থী পেতাম। ফলে শিক্ষা পর্যটনে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে থাকতে পারতো।
ঞ) ১৯৭৩ সালের ১৮-২৪ অক্টোবর জাপান সফরকালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণের সূচনা করেন। ১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হাজার হাজার ভেঙ্গে দেওয়া সেতু, কালভার্ট মেরামত ও পুননির্মাণ এবং সড়ক নির্মাণ করেন। যোগাযোগ পর্যটনের অন্যতম প্রধান উপাদান। তিনি যেই গতিতে মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন, এই গতিতে চলতে থাকলে বাংলাদেশ বহু পূর্বেই পর্যটনে অনেক বেশি সমৃদ্ধ হতো।
ট) ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশের ১৩৬তম সদস্যপদ লাভ ও ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ প্রদান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৪-২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ছাড়াও বাংলাদেশের প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও শিল্পীরা উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশকে শিল্প-সংস্কৃতিবদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গঠন এবং বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ধরে রেখে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশি শিল্পকলা একাডেমি গঠন করেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এই কর্মকান্ডগুলি বঙ্গবন্ধুর সাংস্কৃতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আমরা এস থেকে যা শিক্ষা গ্রহণ করি, তা হলো সাংস্কৃতিক পর্যটনের জন্য বাংলাদেশ হতে পারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। মাত্র সাড়ে ৩ বছরে তিনি আমাদেরকে এই পথও দেখিয়েছেন।
ঠ) ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, পাঁচ হাজার টাকার ওপরে কৃষিঋণ মওকুফকরণ এবং ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে এনে সামাজিক অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জমি মালিকানার সিলিং পুনর্নির্ধারণ ছিল ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এইসব পদক্ষেপ ধরে রাখতে পারলে মানুষের মধ্যে দারিদ্র হ্রাস, উৎপাদন বুদ্ধি এবং সামাজিক পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতো। যা গন্তব্যের স্বাগত জনগোষ্ঠীর মান বৃদ্ধি করতো, তাদেরকে অনেক বেশি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগুলি সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করতো। বলা বাহুল্য যে, সমৃদ্ধ স্বাগত জনগোষ্ঠী ছাড়া কোন দেশে পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠে না।
ড) বঙ্গবন্ধু সরকার নগরভিত্তিক ও গ্রামীণজীবনের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ৫০০ ডাক্তারকে গ্রামে নিয়োগ করেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে IPGMR শাহবাগ হোটেলে স্থানান্তর হয়। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প গ্রহণ বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আজও স্বীকৃত। এইসব প্রগতিশীল পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে পারলে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য পর্যটনের অন্যতম গন্তব্যে পরিণত হতো। এখানে গড়ে উঠতো আধুনিক চিকিৎসার স্বাস্থ্য পর্যটন এবং আয়ুবের্দিক পর্যটন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটনে আমাদের অংশগ্রহণ সম্প্রসারিত করা উচিত।
ঢ) শূন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে শুরু করতে হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্য। এ ছাড়া জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে বঙ্গবন্ধু তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বের ছাপ রাখতে সমর্থ হন। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা রোধ এবং বিশ্বশান্তির প্রতি ছিল তাঁর দৃঢ় সমর্থন। এ ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে প্রদান করে ‘জুলিওকুরি’ শান্তিপদক। বঙ্গবন্ধুর এইসব কর্মকান্ড কাজে লাগাতে পারলে এদেশে বাংলাদেশে বহুধরণের মিটিং, সম্মেলন, মেলা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশকে MICE (Meeting, Incentive, Conference and Exhibition) ট্যুরিজম গন্তব্যে পরিণত করা যেতো।
উপর্যুক্ত আলোচনা ও বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে পরিস্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, জাতির পিতার আদর্শ অনুসরণ করে সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সুশীল পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে তা হতো সকলের কাঙ্খিত একটি বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু এখনো আমাদের সব প্রেরণার উৎস। তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবনাগুলি একান্তভাবেই আমাদের। তিনি এমন একটি School of Thought সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা পুরাণের পাশুপত অস্ত্রের মতো যে কোন কঠিন যুদ্ধ জয়ে ব্যবহার করা যায়। পর্যটনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ও মানুষের টেকসই উন্নয়নের এই যুদ্ধেও বঙ্গবন্ধুর পাশুপত অস্ত্র দিয়ে জ্ঞানের লড়াইটি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাঁর সম্পাদিত সকল কর্মকান্ডকে বিশ্লেষণ করে একটি প্রসারিত সময়রেখা অংকন করতে পারলে একটি প্রগতিশীল পর্যটনযুদ্ধের আয়োজন করা যায়, যা জাতীয় জীবনে খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।