পর্যটন শব্দের ইতিহাসের গল্প
Tweet
আমরা পশ্চিমা ইতিহাস থেকে জানি যে, ল্যাটিন শব্দ Tornare এবং গ্রীক শব্দ Tornos (অর্থাৎ ‘বৃত্তাবদ্ধ পরিভ্রমণ’) থেকে Tour শব্দের উৎপত্তি এবং এর সাথে ism (অর্থাৎ action) যুক্ত করে Tourism শব্দটি রূপলাভ করেছে। ইতিহাস থেকে আরো দেখা যায় যে, ১৭৭২ সালে Tourist শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। তবে অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী ১৮ শতকের শেষের দিকে ইংরেজি সাহিত্যে Tourist শব্দটির ব্যবহার করা হয়। অতঃপর ১৯১১ সালে Tourism শব্দটি ব্যবহৃত হয় এবং ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO) প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে Tourism শব্দটি ব্যবহার করে। আমরা বাংলায় এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘পর্যটন’ ব্যবহার করি। প্রশ্ন হলো বাংলা ‘পর্যটন’ শব্দ কি ইংরেজি ‘Tourism’ শব্দের প্রতিশব্দ?
তাহলে এবার ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া যাক। দার্জিলিংয়ে অবস্থিত ‘এসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন এন্ড ট্যুরিজম’ নামক একটি বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতিকালে এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাকরণবিদ ও ভাষাবিদদের শরণাপন্ন হলে তারা ইতিহাস অনুসন্ধান শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সত্য উদঘাটন করেন। গবেষণা চলছে। আশা করছি শিঘ্রই আরো নতুন ও চমকে দেওয়ার মতো তথ্য বেরিয়ে আসবে। যা পর্যটনের নতুন ইতিহাস ও নতুন অর্থ নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হবে।
ঋগবেদের (খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতক) শ্লোকে ‘ভ্রম’ শব্দটি পাওয়া যায়, যার অর্থ উদ্দেশ্যহীনভাবে কোন স্থান থেকে অন্যত্র বহির্গমন বা উক্ত স্থানে আগমন। এই ভ্রম থেকে ‘ভ্রমণ’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। অতপর খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতকে পাণিনি নামক একজন সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ বলেন যে, ‘পর্যটন’ শব্দটি পরি + অট্ + অন (ল্যুট) থেকে উদ্ভব হয়েছে। সংস্কৃত শব্দ ‘পারিয়া’ থেকে ‘পরি’ অর্থাৎ উদ্দেশ্য এবং অট্ + অন অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনাগমন। এখান থেকে সৃষ্ট ‘পর্যটন’ শব্দের অর্থ হলো উদ্দেশ্য সম্বলিত গমনাগমন। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ২য় শতকে রচিত উপনিষদে ৪টি ধাপে মানব মনের ‘তুরীয়’ অনুশীলন পরিলক্ষিত হয়। এই অনুশীলনে প্রথম ধাপে মানবমন জাগ্রত হয়, দ্বিতীয় ধাপে স্বপ্ন দেখে, তৃতীয় ধাপে গভীর নিদ্রামগ্ন হয় এবং চতুর্থ ধাপে সমাধিপ্রাপ্ত হয়। ৪ ধাপের এই অনুশীলনের জন্য একজন মানুষের বিভিন্ন স্থানে গমাগমন ছিল বাধ্যতামূলক। এভাবে সফল মানুষেরা তৎপরবর্তীকালে সহজেই এক স্থানে বসে মনের ভ্রমণ (Travel of Mind) করতে পারেন। দেহের ও মনের উৎকর্ষ সাধনের জন্য তুরীয় অনুশীলন খুব কার্যকর। ‘তুরীয়’ অনুশীলন যিনি করেন তাকে ‘ট্যুরিস্ট’ বলা হয়। তুরীয় শব্দের সাথে ‘ইজম’ যোগ করে আধুনিক ‘ট্যুরিজম’ শব্দের উদ্ভব ঘটে। সতেরো ও আঠারো শতকে বৌদ্ধগুরু মহাযানি মতাবলম্বীরা তাদের জীবনধারা ও ধর্মানুশীলনে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেন। ফলে এরা তুরীয় অনুশীলনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলতেন। অর্থাৎ পর্যটন ছিল তাদের জীবন গড়ে তোলার এবং জ্ঞান অর্জনের প্রধান অবলম্বন। কোন বিনোদনের বিষয় নয়।
ইতিহাস বলছে, ৩য় মৌর্য সম্রাট অশোকের শাসনামল (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৯ থেকে ২৩২) থেকে এই শব্দগুলির উদ্ভব ও ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তিনি শুধু বর্তমান ভারত ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলি শাসনই করেননি বরং এসব অঞ্চলের সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের বাইরেও তিনি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁর রাজত্ব ছিলো বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা, বাংলাদেশ এবং নেপালের কিয়দংশ জুড়ে। উপর্যুক্ত ব্যুৎপত্তিগত দিক বিশ্লেষণ করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, ‘ভ্রমণ’, ‘ট্যুরিজম’ ও ‘পর্যটন’ এই ৩টি শব্দের উৎপত্তিস্থলই ভারত উপমহাদেশ।
এবার এই শব্দগুলির অর্থ নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করা যাক:
ক) ‘ভ্রমণ’ মানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে উদ্দেশ্যহীন অবস্থায় আসা-যাওয়াকে বুঝানো হত, যা আজ থেকে অন্তত ২,৫০০ বছর আগে বৈদিক আমলের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ ছিল বলে নিদর্শন পাওয়া যায়। অর্থাৎ এতো প্রাচীন আমলে ভ্রমণকে লিপিবদ্ধ করে ঋকবেদ।
খ) অন্যদিকে ‘পর্যটন’ শব্দের অর্থ হলো উদ্দেশ্য নিয়ে গমনাগমন। যা আজকের আধুনিক পর্যটনের অর্থের সমার্থক।
গ) বিভিন্ন স্থানে গমনাগমনের মধ্য দিয়ে মনের ৪টি ধাপে যিনি তুরীয় অনুশীলন করেন এবং শেষবধি মনের ভ্রমণকে (Travel of Mind) নিশ্চিত করতে পারেন তিনিই ‘ট্যুরিস্ট’। আর এই শব্দের সাথে ইজম যোগ করে ‘ট্যুরিজম’ শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ নিজেকে অনুধাবণের পন্থা।
ঘ) পর্যটন কোন বিনোদনের বিষয় নয়। বরং জ্ঞান ও সংকল্প দিয়ে জীবন গড়ার অনুশীলন।
মোখলেছুর রহমান
আহ্বায়ক, সম্মিলিত পর্যটন জোট