ফুটবল আকাশের শুকতারা একজন ম্যারাডোনা
Tweet
মোহাম্মদ আলী শাহঃ সুযোগ তৈরি করে হলেও আমি স্টিভেন জেরার্ডের প্রসঙ্গ যেকোন ফুটবল আলোচনায় টেনে আনি। এই একটি প্রসঙ্গ আমি লক্ষ কোটিবার বললেও এতটুকু বিরক্ত হবো না! প্রসঙ্গটি হচ্ছে, সেরা স্কোয়াড নিয়ে একটির পর একটি শিরোপা জেতার চেয়েও আমি বেশি মুগ্ধ হই দূর্বল একটি স্কোয়াড নিয়ে বছরের পর বছর প্রাণপন যুদ্ধ চালিয়ে শিরোপা জয় করাকেই। প্রতিটি দলেই তো একজন নেতা থাকেন, কিন্তু ক’জন নেতা জেরার্ড এর ইমপ্যাক্ট নিয়ে বছরের পর বছর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন? ক’জন নেতা শুধু দলের সহযোগী খেলোয়ারদেরই নয়, পুরো গ্যালারী কে হাতের ঈশারায় গর্জনে পরিনত করেছেন?? ক’জন নেতা নিজে সেরাটা দেয়ার পাশাপাশি অন্যদের কাছ থেকেও সেরাটা বের করে আনতে সমর্থ হয়েছেন?
লিজেন্ডারী ফুটবলার, কোচ-ম্যানেজার কিংবা পন্ডিতরাও যেকোন ফুটবল আলোচনায় কিছুটা বায়াস্ড। প্রত্যেকেই নিজের পছন্দের দল কিংবা খেলোয়াড়ের পক্ষে কথা বলতে ভালবাসেন। অল্প যে ক’জন ব্যতিক্রম আছেন, তাদের মধ্যে একদম প্রথম সাড়ির একজন হচ্ছেন “এরিক কেন্টোনা”। খেলার মাঠে তো অবশ্যই, এমনকি কথা বলার সময়ও তিনি ছিলেন একজন কিং।
স্পষ্টভাষী ক্যান্টোনা অসম্ভব স্ট্রংলি বলেছেন—
ম্যারাডোনা ৮৬ সালের বিশ্বকাপ জিতেছেন। ৯০ সালের বিশ্বকাপ একদম শেষ মুহূর্তে এসে হেরেছেন। হয়ত ৯৪ সালের বিশ্বকাপও জিত যেতেন যদি বহিষ্কার না হতেন! উনার সাথে পৃথিবীর অন্য সব বিশ্বকাপ জয়ী নেশন্সের পার্থক্য ছিল, অন্য যেকোন নেশন্স যখনই বিশ্বকাপ জিতেছেন তাদের একটি সেরা স্কোয়াড ছিল। উনার আগে কখনোই কোন বিশ্বকাপ জেতা ফুটবল নেশন্স কোন একজন খেলোয়াড়েক উপর শতভাগ ডিপেন্ডেবল ছিলো না কিংবা কোন একজন খেলোয়াড়ের শূন্যতায় দিশেহারা হয়ে যেতো না। ফুটবল দলীয় খেলা, কিন্তু এই ফুটবল খেলাটায় ব্যতিক্রম ছিলেন একজন দিয়েগো ম্যারাডোনা।
ম্যারাডোনার জীবনী নিয়ে বানানো একটি মুভি অনেকদিন আগে দেখেছিলাম। যে সকল আর্জেন্টাইন সমর্থক কারণে-অকারণে কিংবা মেসিকে নিয়ে সামান্য কিছু নেগেটিভ কথা বললেই ম্যারাডোনাকে ট্রল কিংবা অপমাণ করেন কিংবা বাজে কিছু বলতে এক মুহূর্তও সময় নেন না, তাদের জন্য এই মুভিটা দেখার বিশেষ অনুরোধ থাকবে।
একজন নাপোলি সমর্থক বলেছিলেন—
“ম্যারাডোনা কে অসম্মান করাটা অন্যায়।”
সমর্থকটি আরো বলেছিলেন— ম্যারাডোনাকে অপমাণ করা মানে গডকে অপমাণ করা। [মুভিতে সেই সমর্থককে দেখতে পাবেন]।
আপনি যদি মুভিটি দেখেন, এই একই ম্যারাডোনার প্রতি আপনার সম্মান বেড়ে যাবে আরো কয়েকগুণ।
এক সময় জুভেন্টাসের সাথে নাপোলি ম্যাচ জিতবে তো দূরের কথা, ফাইটও দিতে পারতোনা! ম্যারাডোনার গোলে যেবার ১-০ গোলে জুভেকে হারানো হল, সেদিনের জয়ের পর থেকে নাপোলির একটি ঘরও বাদ ছিলোনা যেখানে অন্তত: ০১টি ম্যারাডোনার ছবি প্রতিটি বাড়িতে ঝুলানো বাকি ছিল! সেই শহরের কোন একটি দেয়ালও বাকি ছিল না যেখানে ম্যারাডোনার প্রতিকৃতি আঁকা হয়নি!
ফুটবল ছেড়েছেন প্রায় ২৮/২৯ বছর হয়ে গেছে। অথচ আজো নাপোলি কিংবা বোকা জুনিয়র্স এর নব্য সমর্থকরা ম্যারাডোনার প্লে-কার্ড নিয়ে স্টেডিয়ামে আনন্দে মেতে উঠেন???
ছোটবেলায় [১৯৮৮-৯০ সালের কথা] গ্রামের হাট-বাজারে কিংবা লাইব্রেরিতে সবসময়ই একটা কমন পোস্টার দেখতে পেতাম! তখনকার দিনে আমরা পছন্দের নায়ক-নায়িকা এবং খেলোয়াড়দের পোস্টার এবং ভিউকার্ড কিনতাম! আমি নিজেও ২/১ টাকা করে জমিয়ে অসংখ্য ভিউকার্ড-পোস্টার কিনেছি! তবে এর মধ্যে অন্যতম একটি কমন পোস্টার কিনেছিলাম দিয়েগো ম্যারাডোনা ‘র।
ঐ পোস্টারে একটি ক্যাপশন ছিল— “#ওরা_আমাকে_এত_মারে_কেন?”
আমাদের সেই সময়টায় মোবাইল ফোন কিংবা ইন্টারনেট ছিল না, এর মানে হচ্ছে কিছুই ছিল না। ফুটবল বিনোদন বলতে ছিল একমাত্র সাদা-কালো টিভিতে দেখা ফুটবল বিশ্বকাপ।
সেই সময়টায় গ্রামে-গঞ্জে এমন অসংখ্য খেলা দেখেছি, যেখানে একই দলের ৫/৬ জনের গায়ে ছিল ম্যারাডোনার জার্সি অথবা ১০ নম্বর লিখা সাদা টি-শার্ট। তখনকার ফুটবলে ১০ নম্বর জার্সির অর্থই ছিল ম্যারাডোনা। কেউ একজন একটু ভালো ড্রিবল করলেই বলা হতো ম্যারাডোনা।
অসম্ভব কষ্ট পাই যখন এই মানুষটাকে নিয়ে বাজে কিছু বলা হয়। উনার কল্যাণেই ফুটবলে সর্বশেষ ১০ নম্বর জার্সিটি এতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে! উনার কল্যাণেই আর্জেন্টিনা টানা দুটি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে এবং একটি বিশ্বকাপ জয় করেছে। উনার কল্যাণেই বিশ্বব্যাপী আর্জেন্টাইন সমর্থক বেড়েছে। আমাদের মনে রাখা উচিত- উনি একজন ফুটবলার, উনি সাহিত্যিকে কিংবা ফিলোসফার নন যে উনি গুছিয়ে গুছিয়ে কথা বলবেন! বেশিরভাগ সময়ই উনার কথাগুলোর ভুল ব্যাখ্য দেয়া হয়। তাছাড়া উনি ভুল বলতেই পারেন কিংবা অনেক কিছু বাড়িয়েও বলতে পারেন, তবুও সেটার জন্য উনাকে গাল-মন্দ করাটা উচিত নয়। অসংখ্য রকস্টার আছেন পৃথিবীতে যারা গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। রকস্টারদের কাজ গুছিয়ে কথা বলা নয়, শুধু গান গাওয়া।
সেদিনের কেনা ম্যারাডোনার সেই পোস্টারের ক্যাপশনটা কেন এমন দেয়া হয়েছিল, সেটা অনেক আগেই জেনেছি। ফুটবলে কোন খেলোয়াড়কে এককভাবে এতটা মার খেতে কোনদিন দেখেনি বিশ্ব, হয়ত আর কোনদিন দেখবেও না।
পোস্টের শুরুতে জেরার্ডের উদাহরণ টানার উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র দিয়েগো ম্যারাডোনা। ফুটবলে এমন একজন নেতা থাকতে পারেন- উনার আগে আর কাউকে দেখেনি বিশ্ব, এতটা ইমপ্যাক্ট থাকতে একজন খেলোয়াড়ের- উনার আগে আর কাউকে দেখেনি বিশ্ব, একজন খেলোয়াড় অলমোস্ট একা বিশ্বকাপ জেতাতে পারেন- উনার আগে আর কাউকে দেখেনি বিশ্ব, একজন মানুষ বিশ্বব্যাপী ফুটবলকে এতটা জনপ্রিয় করতে পারেন- উনার আগে আর কাউকে দেখেনি বিশ্ব, একজন মানুষ ফুটবলকে এতটা আদর করতে পারেন বাঁ পায়ের স্পর্শে- উনার আগে আর কাউকে দেখেনি বিশ্ব।
কোন বলই এতটা ভাল অভিজ্ঞতা পায়নি, যখন সেটি ম্যারাডোনার বাঁ পায়ে ছিল! — জর্জ ভালদানো