মেঘবালিকা সাজেক
Tweet
পাহাড়ে যাচ্ছি।
পাহাড়ে যেতে যে খুব ভাল লাগছে তা বলা যাবে না। কিন্তু যেতে হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কারণে মনের মধ্যে ভয়ের একটা গাছ ঢুকেছে। বট গাছ। প্রথমে ছোট ছিল। আস্তে আস্তে ভয়ের গাছটা বড় হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে তার শিকড় বড় হচ্ছে। গাছটাকে উপড়ানো দরকার। সেই গাছ উপড়ানোর জন্যই যাচ্ছি।
এর থেকে বড় সমস্যা এতদিন ঘরে থেকে সোফিয়া অস্থির হয়ে আছে। পাহাড়ে যাবে। আমি বললাম,“ সোনামনি পাহাড়ে যেয়ে কি হবে? পাহাড়ে ওঠা কষ্টের।”
আমার মেয়ে ঠোট ফুলিয়ে বলল,“আমার বন্ধু পাহাড়ে উঠেছে। আমিও উঠব। আমি পাহাড়ে যাব। এখনই যাব।”
আমি বললাম,“ মহামুশকিল। বললেই তো হলো না। পাহাড়ে যেতে বললেই কি পাহাড়ে যাওয়া যায়? তার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে। তার ওপর আবার করোনা ভাইরাসের ভয়।”
আজকাল তো রাস্তা ঘাটে উদ্ভট পোশাক পরা মানুষ দেখা যায়। যাদের দেখলেই মনে হয় এরা মঙ্গল গ্রহ অভিযানে গেছিল। মাত্র ল্যান্ড করেছে। অদ্ভুত পোশাকে তাদের হাঁটার ভঙ্গীটাও অনেকটা নভোচারীদের মতো।
সোফিয়ার আম্মু বলল,“ অত কিছু ভাবলে কি আর বাইরে যাওয়া যাবে?” কথা সত্য। আবার একই সাথে সত্য হচ্ছে বাইরে ঘোরাঘুরির মতো অবস্থা এখন নেই।
এই যখন অবস্থা তখন পাহাড়ে যাব কি ভাবে?
ফেসবুকে পাহাড়ের ছবি দেখি। মেঘের ছবি দেখি আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলি। আহা! কি সুন্দর নির্মল বায়ু। যেতে পারলে হতো। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। সোফিয়ার আম্মু বলল,“ এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো।”
“তেমন কিছু না। এই একটা ছবি।”
“তেমন কিছু না। সে তো বুঝলাম। কিন্তু এতো মনোযোগ দিয়ে দেখার কি আছে। কই দেখি আমাকে দেখাও।”
আমার অবস্থা স্কুলের মাস্টার এর হাতে ধরা খাওয়া বালকের মতো। আমি আস্তে করে মোবাইলটা দিয়ে দিলাম। মোবাইলের স্ক্রিনে মেঘ আর আকাশ। কেউ একজন সাজেক গেছে তাদের ছবি। আহা! কি সুন্দর।
আমি বললাম,“ দারুণ না!”
সোফিয়ার আম্মু মোবাইলটা আমাকে দিতে দিতে বলল,“ হুঁ।”
শুধু হুঁ। এই জন্য বলে মানুষ সংসারি হলে আবেগ অনুভুতি সব হারিয়ে ফেলে। এত সুন্দর একটা ছবি দেখালাম। আর কি না বলে হুঁ। আমি বললাম,“ হুঁ। মানে কি?”
“তোমার খুব পাহাড়ে যেতে ইচ্ছা করছে, তাই না?”
আমি মাথা চুলকে বললাম,“ হ্যাঁ। যেতে তো ইচ্ছা করছে। কিন্তু এই করোনা মাহামারির মধ্যে যাওয়া একটা রিস্কের ব্যাপার। তারপর আরও ঝামেলা আছে?”
“আর কি ঝামেলা?”
“ঝামেলা মানে। ধরো যেতে হলে বাসের টিকিট কাটতে হবে। কোথায় খাবো তার ব্যবস্থা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা ভাল হোটেল লাগবে। কারণ সাথে সোফিয়া যাবে।”
সোফিয়ার আম্মু বলল,“ এই সব ঝামেলার সমাধান হলে তুমি যাবে?”
“অবশ্যই যাব। কিন্তু তারপর ধরো সাজেক যাওয়ার পরে কোথায় কোথায় ঘুরতে হবে সেটাও তো একটা ব্যাপার। সেই সব পয়েন্টে কি ভাবে যাবো সেটা ঠিক করতে হবে। এত কিছু আমি পারব না।”
“তোমার কিছু করতে হবে না। অফিস থেকে ছুটি নিতে পারবে?”
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। আস্তে করে বললাম,“ না। এখন ছুটি নেয়া যাবে না।”
“আচ্ছা ছুটি নিতে হবে না। বৃহস্পতিবার রাতে গেলে হবে। রোববার সকালে ঢাকায় ফিরব। ফিরে অফিসে যেতে পারবে।”
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনছি। কারণ রোববার বিকালে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। আচ্ছা দেখা যাবে। সব কিছু মাথায় নেয়ার কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যাব কি ভাবে?
“তোমার কিছু করা লাগবে না। যা করার আমিই করবো।”
আমি মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সোফিয়ার আম্মু ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এর টিচার ছিল। সুতরাং এই সব বিষয় সে মোটামুটি ভালই বুঝবে। দেখা যাক কি হয়। বৃহস্পতিবার অফিস থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। বাসায় ফিরে দেখি ছোট সোফিয়া তার ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে সোফায় বসে আছে।
“আব্বু চলো।”
আমি বললাম,“ কোথায়?”
“পাহাড়ে।”
“সে তো রাতে যাবো। খাওয়া দাওয়া করে রেডি হই। তারপর যাব।”
সোফিয়া হাত ধরে টানছে। “ না। এখনই চলো।”
আমি বললাম,“ আম্মুকে নিয়ে যাবে না?”
সোফিয়া বলল,“ আম্মু পরে রিক্সায় করে আসবে।” আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লাম। ঢাকা থেকে সোফিয়ার আম্মু সাজেক যাবে রিক্সায় করে!
রিক্সায় করে যাওয়া যাবে না। যেতে হবে বাসে। রাতের বাসে। হাতে বেশী সময় নেই ব্যাগ গোছাতে হবে। ফোন বাজছে। বেজেই চলেছে। সোহাগ ফোন করেছে। দেরি করা যাবে না। সময় মতো কাউন্টারে থাকতে হবে।
সাজেক যাওয়ার ব্যাপারটা অদ্ভুতভাবে সহজ হয়ে গেছে। বিষয়টা যে এত সহজে হবে তা কল্পনাও করতে পারি নি। সোফিয়ার আম্মু ট্যুর গ্রুপ খুঁজে বের করেছে। গ্রুপের নাম Tour Group BD। তারা আমাদের নিয়ে যাবে। আমি বললাম,“ এই সব ট্যুর গ্রুপ কিন্তু আজে বাজে টাইপের হয়।”
“কেমন আজে বাজে টাইপের?”
“আমার মনে হয় ছেলে ছোকরার দল এই সব গ্রুপট্রুপ করে। এদের সাথে কি যাওয়া ঠিক হবে?”
সোফিয়ার আম্মু বলল,“তোমার সমস্যা কি ছেলে ছোকরা? না কি সার্ভিস? তুমি তো ছেলে ছোকরাদের কোলে বসে যাবে না। তুমি যাবে বাসে চড়ে। থাকবে নিজের হোটেলে।”
“তা ঠিক আছে। কিন্তু বয়সের একটা ব্যাপার আছে। ওরা ধরো হৈচৈ করবে। মানে বোঝতো?” আমি চুপ করে গেলাম।
“আমি বুঝেছি। তোমার কিছু বোঝার দরকার নেই। চলো ওদের সাথে যাই। একবার গেলেই বোঝা যাবে। যদি সমস্যা দেখি আমরা আমাদের মতো থাকব। আলাদা গাড়ী নিয়ে ঘোরঘুরি করব।”
আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে। সেই মতো সব ঠিক ঠাক। সব কিছু ট্যুর গ্রুপ বিডি করবে। আমি শুধু বাসে চড়বো। বাসে চড়ার জন্য সন্ধ্যা থেকে তিনবার সোহাগ ফোন করেছে। যাতে আমাদের দেরি না হয়।
আমাদের দেরি হয় নি। সময় মতো বাসে উঠতে পেরেছি। তবে বাসে উঠে যা হয়েছে তাও ভোলার মতো না।
খাগড়া ছড়িতে বাস থেকে নামার পর বেশ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সবাই সমানে বমি করছে। যারা এখন বমি করছে না তাদের হাতে সারারাত বমি করার হলুদ পলিথিন। আমি হকচকিয়ে আাশে পাশে তাকালাম। ঘটনা কি?
খাগড়াছড়ির কোন একটা জায়গাতে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বাসটা হুশ্ করে চলে গেছে। চারিদিকে কিছু নেই। একেবারে নিস্তব্ধত। এর মধ্যে শুধু বমির টক্ টক্ গন্ধ।
আমি নামার পর থেকে দেখছি ঘাড়টা ব্যথা। ডানে বামে ঘুরানো যাচ্ছে না। ঘটনা কি। রাতে বাসে ঘুমানোর জন্য এমন হতে পারে। সোফিয়ার আম্মুকে বললাম,“ ঘাড়টা একটু ব্যথা করছে।” এমনি কথার কথা বলা আর কি।
সোফিয়ার আম্মু সোফিয়ার চোখে মুখে পানি দিতে দিতে বলল,“গতকাল রাতে কি হয়েছে তুমি জান?”
আমি বললাম,“ কি হয়েছে? কিছুইতো হয় নি।”
“বাসের অর্ধেক মানুষ খাগড়াছড়ি ঢোকার মুখ থেকে বমি করা শুরু করেছে। আর তুমি মরার মতো ঘুমাচ্ছো।”
আমি বললাম,“ কেন? সবাই মিলে একসাথে বমি করার মতো কি হলো?”
“জেগে থাকলে টের পেতে। রাস্তা একবার ডানে। আর একবার বামে। ডান বাম করতে করতে মানুষজন বমি করা শুরু করেছ।”
এখন বুঝলাম ঘাড়ে ব্যথার কারণ। বাস একবার ডান একবার বাম হয়েছে। সাথে সাথে আমার ঘাড়ও এদিক ও দিক হয়েছে। ফলাফল ঘাড়ে ব্যথা। কিন্তু ব্যথার তখনো কিছুই হয় নি।
পিকচার আভি বাকিহে মেরে দোস্ত।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাওয়ার সময় শুরু হলো মূল পিকচার। পাহাড়ী রাস্তা। সেই রাস্তার কোন মা বাপ নেই। একবার ডানে একবার বামে তো আছেই। এর সাথে আছে খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠা। পাহাড় বেয়ে উঠছি তো উঠছিই। এর কোন শেষ নেই। খাড়া পাহাড়। একবার একটু এদিক ও দিক হলে সোজা নীচে। তার মাঝে মাঝে পুরষ্কার হিসাবে আছে রাস্তার মাঝে বড় বড় গর্ত। আমার অনুভূতিটা হচ্ছে কান ধরে ওঠ বস করার মতো। ওঠ্ বস। ওঠ্ বস। ওঠ্ বস…।
আকাশে তপ্ত রোদ। যেন চামড়া ভেদ করে চলে যাচ্ছে। আমরা যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। আমার হাড়গুলো মনে হয় গুড়াগুড়া হয়ে গেছে।
রাস্তার ধারে ছোট ছোট উপজাতি ছেলে মেয়ে। হাত নাড়ছে। আমার পেছনে বসা একজন এক মুঠো চকলেট ছুড়ে দিল। সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে সেই চকলেটের জন্য। কী অদ্ভুত জীবন। সোফিয়া বলল,“ আব্বু।”
আমি বললাম,“ বলো।”
“ওরা এমন করছে কেন?”
“কেমন করছে?”
“রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে চকলেট কুড়াচ্ছে কেন?”
“ওদের কাছে চকলেট নেই। এই কারণে ওরা চকলেট কুড়াচ্ছে।”
“আব্বু ওদের রোদ লাগছে না।”
“হ্যাঁ। রোদ লাগছে। তোমার কি রোদ লাগছে?”
“খুব গরম লাগছে।”
আহারে আমার মেয়েটা। গরমে অস্থির হয়ে গেছে। আমার কাছে ছোট একটা ব্যাগ। সেই ব্যাগ থেকে গামছা বের করে সোফিয়াকে মুড়ে দিলাম। যদি রোদের তাপ তাতে একটু কম লাগে।
আমাদের হুটখোলা জিপ চলছে। এই জিপকে বলে চাঁদের গাড়ী। চাঁদের দিকেই চলেছে। চারিদিকে নির্জন পাহাড়। গাড় নীল আকাশ । সেই নীলের নিচে বহুদূর দেখা যাচ্ছে সবুজ গাছ। আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে পেঁজা তুলার মতো মেঘ। এই মেঘের মাঝে খুব উঁচুতে বাড়ী জাতীয় কিছু একটা দেখলাম। এটাই মনে হয় হোটেল।
কষ্টের পরে স্বস্তি আছে। হোটেলে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
হোটেল দেখে মন ভাল হয়ে গেছে। মনটা ভাল হয়ে যাওয়ার কারণ আছে। প্রথম কারণ হোটেল পাহাড়ের এক পাশে। ছোট কটেজ। পাশাপাশি দুইটা রুম। রুমগুলো আশ্চর্য রকম নৈপুন্যে বাঁশ দিয়ে বানানো।
জীবনে বাঁশ অনেক খেয়েছি। কিন্তু বাঁশের ঘরে থাকে নি। এরা বাঁশ দিয়ে হোটেল বানিয়েছে। হোটেল না বলে কটেজ বলাই মনে হয় ভালো। সেই কটেজে বড় বড় জানালা। জানালা খুলে দিলে দিগন্তজোড়া পাহাড় আর মেঘের খেলা।
কটেজে ছোট একটা বারান্দা। সেই বারান্দায় দাঁড়ালে মেঘের ছুটোছুটি দেখা যায়। সোফিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল,“ আব্বু আমি মেঘ খেতে চাই।”
আমি প্রথমে কথাটা শুনতে পাইনি। আমি আসলে বাথরুম খুঁচ্ছিলাম। বাঁশের হোটেলে বাথরুম জিনিসটা কোথায় থাকবে সেটা বুঝতে পারছি না। হয়ত গরমে মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না। না হলে আস্ত একটা কটেজে বাথরুম খুঁজে পাব না কেন?
সোফিয়া আবার চিৎকার করছে।“ আব্বু! আব্বু!”
আমি চিৎকার করে বললাম,“ কি হয়েছে আম্মু?”
“আমি মেঘ ধরতে চাই।”
আমি বললাম,“ মেঘ ধরতে চাই মানে কি? মেঘ কি কোন কোল বালিশ যে তুমি সাথে করে নিয়ে ঘুরবে।”
সোফিয়ার কোলবালিশ নিয়ে একটা ঘটনা আছে। সোফিয়ার দাদা তাকে একটা কোলবালিশ গিফট করেছে। এখন এই কোলবালিশ হয়েছে আমাদের জ্বালা। সে যেখানে যাবে সাথে করে কোলবালিশ নিবে। হোটেলে খেতে গেলে সাথে কোলবালিশ থাকবে। বেড়াতে গেলে। ট্রেনে বাসে সব যায়গাতে কোল বালিশ।
“আব্বু। তুমি মেঘ ধরে দাও। আমি মেঘ নিব।”
ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য বললাম,“আচ্ছা মেঘ ধরে দিব। সোহাগ আংকেল কে বলব। তোমাকে বোতলে করে মেঘ দিয়ে দিবে।”
মনে মনে ভাবছি সোফিয়া বেশী ঝামেলা করলে সোহাগকে বলব, বোতলে খানিকটা ধৌঁয়া ভরে দিতে। সোহাগের বিষয়টা অদ্ভুদ। প্রদীপের জ্বীনের মতো জ্বী হুজুর হাজির। সোফিয়ার আম্মু বলল সোফিয়ার এই খাবার গরম করতে হবে। সোহাগ সাথে সাথে ব্যবস্থা করে ফেলল।
তার জন্য মেঘ ধরা আর কি ব্যাপার! বললে নিশ্চয় এক খন্ড মেঘ ধরে আমাদের ব্যাগের মধ্যে দিয়ে দিবে। কিন্তু মেঘ দেখতে হলে যেতে হবে পাহাড়ে। কংলাক পাহাড়ে।
কংলাক পাহাড়ে যাচ্ছি। দুপুরে খাওয়া হয়েছে। এখন একটু পাহাড় দেখতে হবে। পাহাড় দেখব না। এখন পাহাড়ে চড়ব।
পাহাড়ের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে সবার মধ্যে লাঠি কেনার কেনার একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে। লাঠির সাইজ হচ্ছে তিন হাত। লাঠি দিয়ে ঠিক কি হবে আমার মোটা মাথায় ঢুকছে না। লাঠির দাম দশটাকা। ঢাকা শহরে পথে চলতে এই লাঠির প্রয়োজন আছে। রাস্তায় যে হারে বেওয়ারিশ কুকুর ঘুরে বেড়ায় এই রকম একখানা লাঠি হাতে থাকলে বেশ সাহস পাওয়া যায়। কিন্তু এই পাহাড়ের দেশে লাঠি দিয়ে কি হবে? সোফিয়া অবশ্য হোটেলে আসা মাত্র আমাকে বলেছে, এই পাহাড়ে বাঘ আছে।
আমি বললাম,“ তুমি কি ভাবে বুঝলে বাঘ আছে?”
সে আমাকে হোটেলের সামনের ঝোপ দেখিয়ে বলল,“ঐ দেখ নড়ছে।”
আমি চশমটা ভাল করে পরে। এদিক ওদিক খুব ভালো করে দেখে বুঝলাম। হ্যাঁ। একটা ঝোপ নড়ছে বটে। কিন্তু তার মধ্যে আর যাই হোক বাঘ থাকবে না।
আমি বললাম,“ কই বাঘ?”
“আব্বু! ঐ দিকে দেখ।”
আমি দেখলাম। ছোট একটা বিড়াল ছানা। আমি বললাম,“ ওতো বিড়াল।”
সোফিয়া চোখ বড় বড় করে বলল,“ বিড়াল ছানা যেহেতু আছে । বাঘ ও আছে।”
বিড়াল ছানার সাথে বাঘের সম্পর্কটা ঠিক বুঝলাম না। আমি বললাম,“ বিড়ালের সাথে বাঘের সম্পর্ক কি?”
“আব্বু তুমি কিছু বুঝ না। বিড়াল হচ্ছে বাঘের মাসি। বিড়াল যেহেতু আছে। বাঘও আছে।”
তা বাঘ থাকতে পারে! বাঘ থাকলে তিন হাত লম্বা লাঠি দিয়ে সেই বাঘকে মারা আমার দ্বারা সম্ভব না। আমার কেন ? আমার দাদারও ক্ষমতা নেই লাঠি দিয়ে আস্ত একটা বাঘ মেরে ফ্যালে।
সবাই গাড়ী থেকে নেমে গেছে। সোহাগ সবাইকে সামনে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। আমি বললাম,“ লাঠি দিয়ে কি হবে?”
সোহাগ ব্যস্তভাবে বলল,“পাহাড়ে উঠতে লাগবে।”
আমার সাধারণ যুক্তি বলছে, পাহাড়ে উঠতে দড়ি লাগে। লাঠি লাগে কি না আমার কোন ধরনা নেই। সবাই লাঠি কিনছে। আমরাও লাঠি কিনলাম। বিষয়টা হচ্ছে -দেখি কি হয়?
পাহাড় আরও খানিকটা দূরে। হাঁটতে হবে। সোফিয়া উৎসাহে হাঁটছে। সে পাহাড়ে উঠবে। পাহাড়ে উঠতে হবে। এই পাহাড়ের নাম হচ্ছে কংলাক পাহাড়।
কংলাক কথাটা শুনলেই মনে হয় কংকাল এর একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। কংকাল এর ব্যাপার স্যাপার আছে কি না জানি না। কিন্তু এই পাহাড়ে ওঠা যে সহজ কোন বিষয় না সেটা দেখলেই বোঝা যায়। খাড়া পাহাড়। আমি উঠব কি উঠব না সেই চিন্তা করছি। সোফিয়া আমার হাত ধরে টানছে। সোফিয়ার আম্মু আমাদের পেছনে। তার মুখ দেখলে মনে হয় তোমাদের বাবা মেয়ের ব্যাপার আমি কি জানি!
আমি পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে ইতস্ত করছি। এক মাঝবয়সি ভদ্রমহিলা পাহাড় থেকে নামছে। তারপাশের জনকে বলছে,“ এই ভাবে ঝুলে কতক্ষণ থাকবে। যদি পা ফসকে যাই তবে কি হবে?”
আমি আড়ি পেতে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করছি। তাদের বক্তব্য থেকে যা বুঝলাম তা হচ্ছে পাহাড়ের মাঝপথে এক মহিলার পা ফসকে গেছে। কোন ভাবে সে একটা গাছের শিকড় ধরে কিছুক্ষণ ঝুলে ছিল। তারপর তাকে উদ্ধার করা হয়েছে।
খাড়া পাহাড়। সোফিয়া আর আমি উঠছি। আমাদের অনেক নিচে সোফিয়ার আম্মু। আমাদের হাতে লম্বা লাঠি। সোহাগকে দেখছি না। আশেপাশে কোথাও আছে হয়ত। উঠছি তো উঠছি। পায়ের নিচে ছোট ছোট পাথর। সেই সব পাথর মাঝে মাঝে গড়িয়ে পড়ছে। আমি সোফিয়াকে পেছন দিক থেকে ধরে রেখেছি। মনে মনে ভাবছি সোফিয়া যদি এখন কোলে উঠতে চাই তাহলেই হয়েছে।
এই যে রিস্ক নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে খাড়া পাহাড়ে উঠলাম। তারপর কি দেখলাম?
না। বলব না। দেখতে হলে কংলাক পাহাড়ে উঠতে হবে। তবে, পাহাড়ে ওঠার পর সোহাগ আমাদের একটা ছবি তুলে ছিল। সেই ছবিটা আপনারা দেখতে পারেন। ছবিটা এর সাথে যুক্ত করে দিলাম।
পাহাড় দেখে যখন হোটেলে ফিরেছি। তখন ক্লান্ত। খিদা লেগেছে খুব। বিকালে আবশ্য সোহাগ আমাদের খাইয়েছে। আমাদের জন্য বাঁশের চোঙের চা। আর সোফিয়ার জন্য কোল্ড কোফি। কিন্তু সেই চা-তে আর খিদা যায় নি।
আমি হোটেল রুম থেকে উপরে গানের গলা শুনতে পাচ্ছি। একজন গান গাচ্ছে আর তার সাথে অন্যরা গলা মেলাচ্ছে। আমি মনোযোগ দিয়ে গান শোনার চেষ্ঠা করছি-
“সর্বত মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রাই
বৃন্দাবনের বংশীধারী ঠাকুরও কানাই
একলা রাধে জল ভরিতে যমুনাতে যায়
পিছন থেকে কৃষ্ণ তখন আড়ে আড়ে চায়”
এরপর কৃষ্ণ বলছে,
“জল ভর, জল ভর রাধে ও গয়ালের ঝি
কলস আমার পূর্ণ কর রাধে বিনতি।”
গান চলছে। একের পর এক গান। কিন্তু আমার খিদা লেগেছে। এই সব পোলাপানের পাল্লায় পড়লে আমার আজকে আর খাওয়া হবে না। সুতরাং এদের আসর ভাঙ্গতে হবে। আমি আসরে বিরাট এক তাত্ত্বিক আলাপ শুরু করলাম। আমি বললাম,“ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কভিড ক্ষতি করেছে। জিডিপি…। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক…। ইত্যাদি ইত্যাদি। বক্ বক।” কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাপ শেষ হয়ে গেল।
সোহাগ বলল,“ চলেন আমাদের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।” আমি নিশ্চিত জানি মনে মনে বলছে, এই চান্নিপসার রাতে আরও কিছুক্ষণ গান গাওয়া যেতো। কিন্তু বেটা হতে দিলো না। আফসোস মানব জাতীর শুধুই খিদা।
রেস্টুরেন্ট থেকে খাওয়া দাওয়া শেষে হোটেলে ফিরছি। সোফিয়ার আম্মু আর সোফিয়া হোটেলে ফিরে গেছে। আমি ভাবলাম হোটেলের লবিতে একটু বসি।
গরমের রাত।
হোটেল এর লম্বা বারান্দায় বসে দুই বন্ধু কাবাব পরোটা খাচ্ছে। আমি তাদের পাশে বসলাম। দুই বন্ধুর বয়স কত হবে? বিশ বা বাইশ বছর হতে পারে। একজন পরেছে ট্যুর গ্রুপ বিডি-র লাল রঙ এর টিশার্ট। আর একজন পরেছে কালো রঙ এর টি শার্ট।
আমি বসতে বসতে বললাম,“খাওয়া দাওয়া কেমন হচ্ছে?”
দুই বন্ধুর মুখেই পরোটা আর মাংশ। কোনক্রমে খাওয়াটা গলা দিয়ে নামিয়ে বলল,“ খুব ভাল হচ্ছে।”
আমি বললাম,“আপনাদের সাথে পরিচিত হই। আমার নাম মাহফুজ। আপনাদেরদের নাম?”
ট্যুর গ্রুপ বিডি-র লাল রঙ এর টি শার্ট পরা ফর্সা ছেলেটা বলল,“আমার নাম রিফাত। আর ও হচ্ছে আমার বন্ধু রাকিবুল। আমারা দুইজন এসেছি।”
আমি বললাম,“দারুণ তো। আপনার দুই বন্ধু এসেছেন!”
“হ্যাঁ। আব্বা মা আসতে দিতে চাচ্ছে না। জোর করেই চলে এসেছি।”
দুই বন্ধু খাচ্ছে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। আহা! কি সুন্দর। পাহাড়ী আকাশে শুকতারা জ্বলজ্বল করে আলো ছাড়াচ্ছে। পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে মাঝে মাঝে বাতাস আসছে। প্রচন্ড গরমে পহাড়ের মাথা ছুঁয়ে আসা বাতাস আচমকা মন ভাল করে দেয়।
আমি রিফাত এর দিকে তাকালাম,“ আপনি কি করেন?”
“আমি কলেজে পড়ি।”
“আপনারা দুইজনই কলেজে পড়েন?”
“আমি বাংলা কলেজে। আর রাকিবুল এআইইউবি-তে।” খাওয়া শেষের দিকে। মনে হয় আর একটা নান হলে ভালো হতো। দুই জনই হাত চাটছে।
“আপনাদের খাওয়া দাওয়া শেষ?” আমার পেছন থেকে প্রশ্নটা করল সোহাগ। সোহাগ হচ্ছে এই ট্যুরে আমাদের গাইড। একমাত্র হোস্ট।
রিফাত নিজের প্লেটের দিকে তাকাল। তারপর বলল,“ আর একটা পরোটা হলে ভালো হতো।”
আমি বললাম “যা খেয়েছেন তাতেই খুশি থাকেন। এত রাতে সে বেচারা পরোটা কোথায় পাবে?”
সোহাগ উল্কার বেগে বের হয়ে গেলো। পরোটার খোঁজে। এই ছেলেটার কার্যক্রমে আমি ক্রমান্বয়ে আশ্চর্য হচ্ছি। ক্রমাগতভাবে সে ঝামেলা ফেস করে চলেছে। কিন্তু ক্লান্তি নেই। যেন আমাদের দাবি পুরণ করেই সে খুশি। কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁফাতে হাঁফাতে সে ফিরে আসল। হাতে গরম পরোটা। বলল,“আরাম করে খান। আরও যদি কিছু লাগে বলবেন। আমি ব্যবস্থা করব।”
দুই বন্ধু গরম পরোটা খাচ্ছে। আমি পাশে বসে টুকটাক করে গল্প করছি। নিজের কাছে কেমন জানি বঞ্চিত মনে হচ্ছে। ইশ এই বয়স তো আমারও ছিল। কিন্তু আমাদের সময় ট্যুর গ্রুপ ছিল না। কোথাও যেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুবান্ধব লাগত। এছাড়া কোন ভাবেই বের হওয়া যেতো না। এখন হয়ত তারা দুই বন্ধু সারা রাত জেগে বসে থাকবে। টুকটাক করে গল্প করবে। চারিদিকে যত নিস্তব্ধ হতে থাকবে তাদের গল্প বাড়তে থাকবে। গল্প করতে করতে হয়ত তারা সকাল দেখবে।
সাজেকের সকাল আমিও দেখলাম।
খুব সকাল। বাইরে মেঘ। মেঘের মধ্যে হাত ধরাধরি করে আমি আর সোফিয়া বের হয়েছি। যাচ্ছি আদ্রিকা কটেজ এর বারান্দায়। সোফিয়ার আম্মু বাইরে আসার জন্য রেডি হচ্ছে। আমি সোফিয়াকে বললাম,“ আম্মু মেঘ খাবে?”
“হ্যাঁ খাব।”
“তাহলে হা করে খাওয়া শুরু করে দাও।” সোফিয়া হা করে মেঘ খাচ্ছে। সোফিয়ার দেখাদেখি আমিও হা করে মেঘ খাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু একটা বিষয় দেখে আমার হা আর বন্ধ হচ্ছে না। চিরতরের জন্য আমার মুখ হা হয়ে গেছে।
চারিদিকে মেঘ। মেঘের মধ্যে মেঘের জামা পরে একটা মেয়ে নাচ্ছে। মেঘ বালিকা। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। আমি চোখ কচলালাম। স্বপ্ন দেখছি নাকি! মেঘের মধ্যে একজন নাচচ্ছে। এই বিংশ শতাব্দিতে? সিন্দাবাদে দেখতাম মেঘের মধ্যে ম্যাজিক কার্পেটে করে উড়ে যাচ্ছে। এখানে মেঘের মধ্যে নাচ।
এটা কেমনে সম্ভব?
যারা এখনো বিশ্বাস করছেন না। তাদের জন্য একটা ছোট ভিডিও আছে কিন্তু পোর্টালে আপলোড করলাম না। এই ভিডিওটা সোফিয়ার আম্মু করেছিল।
ভাগ্যিস করেছিল। নইলে কেউ তো আর বিশ্বাস করত না।